কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ

অন্ধকারে আলো দিচ্ছে পপির ভাসমান স্কুল

কিশোরগঞ্জে ‘পপি’র ভাসমান স্কুল। ছবি : কালবেলা
কিশোরগঞ্জে ‘পপি’র ভাসমান স্কুল। ছবি : কালবেলা

বর্ষায় ‘নাও’ আর শুকনায় ‘পাও’। কিশোরগঞ্জের হাওরের মানুষের এটি প্রবাদ বাক্য ও চিরচেনা রূপ। এখানকার জনপদের মানুষ সবসময় অবহেলিত। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া এক বিরাট জনগোষ্ঠীর বসবাস নিকলী উপজেলার ঘোড়াউত্রা নদীপাড়ের দুটি ইউনিয়ন ছাতিরচর ও সিংপুরে। এ দুই ইউনিয়নের অধিকাংশের পেশা কৃষি ও মৎস্যজীবী। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা এ মানুষগুলোকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘পপি’ চালু করেছে ভাসমান স্কুল। অভিভাবক ও এলাকাবাসীর কাছে এসব স্কুল এখন জলে ভাসা স্কুল হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে।

২০০৯ সালের দিকে সংস্থাটি ছাতিরচর ইউনিয়নে চারটি এবং সিংপুর ইউনিয়নে তিনটি একতলা ও দ্বিতল নৌকায় ভাসমান স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। একই সঙ্গে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণসহ নানা সেবা প্রদানের দায়িত্ব নেয়। বিনামূল্যে বই-খাতা, কলম, জ্যামিতি বক্স, স্কুল ড্রেস, ব্যাগ, জুতা, টিফিন ও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে হাওরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে সাতটি ভাসমান স্কুল। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের মনোরঞ্জনে রয়েছে খেলাধুলার আয়োজন।

সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত চলে এসব ভাসমান স্কুলের ক্লাস। লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলে রয়েছে লাইব্রেরি ও শিক্ষণীয় ফটোগ্যালারির পাশাপাশি খেলাধুলার নানাবিধ আয়োজন। আর্থিক সংকটের কারণে একসময় অনেক পরিবারের ছেলেমেয়ে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল।

চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মীম আক্তার জুঁই বলেছে, আমাদের গ্রামের চারপাশে নদী। এখানে একটি স্কুল থাকলেও আমাদের লেখাপড়া করার মতো যে খরচ প্রয়োজন, তা সম্ভব হয় না। ভাসমান স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকেই পড়ালেখা করে আসছি। স্কুলে যা প্রয়োজন সবই স্যাররা আমাদের দিয়ে দেন। স্কুল ড্রেস থেকে শুরু করে টিফিন পর্যন্ত সব।

মা-বাবা হারানো শিক্ষার্থী আকাশের ভাষ্য, আমার মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমি আর পড়াশোনা করতে পারছিলাম না। এমন সময় স্কুলের একজন ম্যাডাম আমাকে খেলার মাঠে গিয়ে পড়াশোনার কথা বললেন। আমিও পড়াশোনা করতে আগ্রহ দেখিয়েছি। এরপর আমাকে পপির ভাসমান স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে সব স্যাররা দিয়েছেন। কোনো কিছু আমার কিনতে হয়নি। এখন আমি চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। এ সময় ম্যাডাম আমাকে ডাক না দিলে পড়ালেখা করতে পারতাম না।

শিক্ষার্থী নাবিলা আক্তার বলেন, আমাদের এখানে বন্যা হয়। বন্যার সময় অনেক স্কুল ডুবে গেলেও আমাদের স্কুল ভেসে থাকে। কখনো ক্লাস বন্ধ থাকে না। এক দিন স্কুলে না এলে স্যার অথবা ম্যাডাম আমাদের বাড়িতে যান। খোঁজখবর নেন আমরা কেন স্কুলে আসিনি। সমস্যা থাকলে সমাধানের চেষ্টা করেন।

ভাসমান স্কুলের শিক্ষিকা রত্না আক্তার বলেন, প্রাক-প্রাথমিক ক্লাস থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করি। এখনো ৩০ শিক্ষার্থী উপস্থিত রয়েছে। এখান থেকে বই, খাতা, কলম, পেন্সিল, ড্রেস, স্বাস্থ্যসেবাসহ যাবতীয় সব কিছু ফ্রিতে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, দুর্যোগের সময় সব শিক্ষার্থীর পরিবারকে ত্রাণ দেওয়া হয়।

অভিভাবক শহীদ মিয়া বলেন, আমরা অনেক গরিব মানুষ, পপির ভাসমান স্কুল হওয়াতে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা করাতে পারছি। আমার বড় ছেলে এখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছে। ছোট ছেলেকেও ভর্তি করেছি। সব কিছু স্কুল থেকেই দেওয়া হয়। আমাদের দাবি আরও স্কুল হোক। কেউ অশিক্ষিত না থাকুক। আমাদের করোনা ও বন্যার সময় সহায়তা দিয়েছে।

অভিভাবক দুধমেহের আক্তার বলেন, আমরার সময় এমন স্কুল ছিল না। গরিব মানুষ তাই লেখাপড়া করতে পারছি না। আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। কোনো টাকা লাগে না। সব পপির থেকে দেওয়া হয়। আমার দুই সন্তান এই স্কুলে পড়ালেখা করে।

নিকলী ভাসমান স্কুলের প্রকল্প সমন্বয়কারী জহিরুল ইসলাম বলেন, নিকলী উপজেলার ছাতিরচর ও সিংপুর ইউনিয়নে ২০০৯ সাল থেকে ভাসমান স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছি। এরই মধ্যে এক হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে অধ্যয়নরত আছে। এ ছাড়া যৌতুক, বাল্যবিবাহসহ তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করছি। এই হাওর অঞ্চলে ভাসমান স্কুল সাড়া ফেলেছে। অধিক চাহিদাও বেড়েছে। যেহেতু সারা বছর পানি থাকে। আমাদের স্কুলগুলো গ্রামের কাছাকাছি থাকায় তারা সহজে স্কুলে আসতে পারে। বর্তমানে সাতটি ভাসমান স্কুল চালু আছে। যেখানে ৩৩০ শিক্ষার্থী রয়েছে।

পপির নির্বাহী পরিচালক মুর্শেদ আলম সরকার বলেন, এখানকার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। সরকারি স্কুল থাকলেও যথেষ্ট নয়। তাই ভাসমান স্কুলের প্রতি চাহিদা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের স্কুলকে এমনভাবে তৈরি করেছি যে, প্রতিটি স্কুলে একসঙ্গে ৫০ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করতে পারবে। দোতলাবিশিষ্ট লঞ্চে একসঙ্গে ১০০ শিক্ষার্থী পড়তে পারবে। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারে। এখান থেকে প্রাইমারি পাস করার পর আমাদের পক্ষ থেকে হাই স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করি। প্রতিদিন টিফিন দেওয়া হয়। তাদের পুষ্টির কথা চিন্তা করে রুটিন অনুযায়ী একেকদিন একেক ধরনের খাবার দেওয়া হয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

একাদশে ভর্তির দ্বিতীয় ধাপের ফল প্রকাশ, যেভাবে দেখা যাবে 

তিন যুবকের কোমরে মিলল আট কোটি টাকার স্বর্ণ

হাসপাতালে খালেদা জিয়া

ইসির রোডম্যাপে দেশ নির্বাচনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল : সমমনা জোট

প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ শাবির ৮৫ শিক্ষকের

প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার তীব্র নিন্দা চুয়েটের

আল আরাফা ব্যাংকের চাকরিচ্যুত ৩ কর্মকর্তা রিমান্ডে, কারাগারে ৮

দাবি আদায় হয়নি, নতুন ঘোষণা শিক্ষার্থীদের

রমনা বিভাগের ডিসিকে নিয়ে অপপ্রচার

নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণায় এবি পার্টির প্রতিক্রিয়া 

১০

বাস্তবায়ন হয়নি ৩৫ বছর আগের খুবি ক্যাম্পাসের মহাপরিকল্পনা

১১

ঋতুপর্ণার বাবা কখনোই চাননি মেয়ে নায়িকা হোক

১২

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাবি উপাচার্যের সাক্ষাৎ

১৩

ফোনের চার্জার যে কারণে সাদা বা কালো রঙের হয়

১৪

পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল

১৫

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম ফিলাপ ফি বৃদ্ধি প্রত্যাহারের দাবি

১৬

গুম করলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন

১৭

ঘুষ লেনদেনের ভিডিও ভাইরাল, দুই ট্রাফিক পুলিশ ক্লোজড

১৮

গাজায় যুদ্ধবিরতি কেন হচ্ছে না, জানাল মিশর

১৯

ডাকসু নির্বাচনে সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার বক্তব্য

২০
X