আসিফ পিনন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৩ পিএম
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

নিঃসন্তান নীলার হাত ধরে দুনিয়ার আলো দেখে ৮০০ শিশু

কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সম্মাননা দেওয়া হয় নীলা বিশ্বাসকে। ছবি : কালবেলা
কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সম্মাননা দেওয়া হয় নীলা বিশ্বাসকে। ছবি : কালবেলা

নীলা বিশ্বাসের স্বামী মারা গেছেন ২০০২ সালে। এখন তিনি থাকেন চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গুজরা গ্রামের একটি কুঠিরে। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই গ্রাম ঘিরেই তার রয়েছে অম্লমধুর স্মৃতি। জীবনের সোনালি সময় কাটিয়েছেন ধাত্রীর কাজে। প্রায় ৫০ বছর ধরে এ দায়িত্ব পালনকালে তার হাত ধরে পৃথিবীর আলো দেখেছে প্রায় ৮০০ শিশু। তখন চট্টগ্রামের গ্রামীণ জনপদে প্রসূতি মায়েদের কাছে ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠেন নীলা বিশ্বাস।

অবাক বিষয় হলো, দীর্ঘ সময় ধরে প্রসূতি মা ও সদ্যোজাত শিশুদের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিলেও দাম্পত্য জীবনে নিজেই ছিলেন নিঃসন্তান। যদিও এ নিয়ে তার ছিল না কোনো আক্ষেপ। জীবনের সুখের এই সময় পার করে প্রবীণ বয়সে স্বামী-সন্তান ছাড়া নীরবেই কাটছে নীলার দিন। জীবনসায়াহ্নে এসে তাদের জন্যই সব সময় প্রার্থনা করেন নীলা বিশ্বাস।

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার এক গ্রামীণ জনপদের ধাত্রী নীলার মহৎ এই কাজ ঘিরে নানা আলোচনা চাউড় আছে। প্রচারবিমুখ নীলার এই সুখ্যাতি অনেকেরই অজানা। তবে রাউজানের বাইরেও নীলার গল্প শুনেছেন কেউ কেউ। অনেকে শুনলেও তাকে দেখেননি।

আশি বছর বয়সী নীলা বিশ্বাস চট্টগ্রামজুড়ে আবার আলোচনায় এসেছেন গত ১৬ অক্টোবর দৈনিক কালবেলার দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ নিয়ে। সেদিন ‘গ্রামীণ জনপদে প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসাসেবায় অসামান্য ভূমিকা রাখায়’ দৈনিক কালবেলার পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া হয় সম্মাননা স্মারক। অনুষ্ঠানে অতীত স্মৃতি ও অপ্রকাশিত অনেক কথা কালবেলার কাছে তুলে ধরেছেন নীলা বিশ্বাস ও রাউজানের বাসিন্দারা।

অনুষ্ঠানে স্থানীয় ব্যক্তিরা স্মৃতিকাতর হয়ে জানান, রাউজানের বাসিন্দাদের কাছে নীলা বিশ্বাস পরিচিত ‘ধরণী আপা’ হিসেবে; যদিও নতুন প্রজন্মের কাছে অপরিচিত মুখ তিনি। ষাটের দশকের গোড়া থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাউজানের প্রত্যন্ত অঞ্চল গুজরা গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে ‘ডা. আপা’ হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ওই সময় রাত-দিন নীলা ছুটে বেড়াতেন প্রসূতি মায়েদের সেবায়। তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওই গ্রামীণ জনপদে গড়ে ওঠেনি রাস্তাঘাট, ছিল না যানবাহন। কোথাও মাইলের পর মাইল হেঁটে, কোথাও রিকশা-ভ্যানে চড়ে প্রসূতি মায়েদের সেবায় ছুটতেন তিনি।

তখন কারও সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় হলেই ঘরে এসেই নীলাকে ডাকতেন প্রসূতি মায়ের স্বজনরা। ১৯৬০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ জনপদে এভাবেই ধাত্রী হিসেবে কাজ করেছেন নীলা। এই দীর্ঘ ৫০ বছরে অনেক প্রখ্যাত চিকিৎসকের সঙ্গেও কাজ করেছেন নীলা। এ সময় তার হাত ধরে ভূমিষ্ঠ হয়েছে অন্তত ৮০০ শিশু।

প্রসূতি মায়েদের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিলেও নিজের নিঃসন্তান থাকার বেদনা কখনো অনুভব করেননি নীলা বিশ্বাস। তা নিয়ে কোনো আক্ষেপও নেই তার। কিন্তু ২০০২ সালে ৭ এপ্রিল স্বামী অনিল বিশ্বাসকে হারিয়ে একা হয়ে পড়েন তিনি। এরপর সুখে, দুঃখে, বিপদে-আপদে পাড়া-প্রতিবেশীরাই হয়ে ওঠে তার আপনজন। ২০১০ সালের পর বার্ধক্যজনিত কারণে এই কাজের ইতি টানেন তিনি।

রাউজানের বাসিন্দা আভা বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, ‘আমার প্রথম শিশু জন্মগ্রহণ করেছে ১৯৭৪ সালে। এখন রাউজানে অনেক চিকিৎসাকেন্দ্র, হাসপাতাল থাকলেও সেই সময়ে এসবের কিছুই ছিল না। গ্রামে ছিল না কোনো চিকিৎসক। তখন নীলা দিদি ছিলেন আমাদের ভরসার নাম। একে একে আমার তিন সন্তান জন্ম হয়। তিন সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় নীলা দিদির হাতে। তখন তো চিকিৎসাসেবা এত উন্নত ছিল না। তৎকালীন চিকিৎসক বলতে আমরা তাকেই চিনতাম।’

জানা গেছে, চট্টগ্রামে প্রাচীনতম হাসপাতাল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল। নগরের প্রাণকেন্দ্র আন্দরকিল্লায় এ হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৪০ সালে। প্রথম দিকে শুধু ডিসপেনসারি ইউনিট চালু থাকলেও কালের পরিক্রমায় বাড়ে সেবার পরিধি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ধাত্রী প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১৯৬১ সালের দিকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের অধীনে ধাত্রী প্রশিক্ষণ নেন নীলা বিশ্বাস। এরপর গ্রামীণ জনপদে ধাত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ পেশাজীবনের বড় একটি সময়জুড়ে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত গাইনি চিকিৎসক ডা. বদরুন নেচ্ছার সঙ্গেও কাজ করেছেন নীলা।

জীবনসায়াহ্নে এসে নীলা বিশ্বাস এখন অনেকটাই বিমর্ষ, একাকিত্ব ঘিরে ধরেছে তাকে। ভুগছেন বুক ব্যথায়। কমে গেছে শ্রবণশক্তি ও চোখের আলো। চলাফেরার সক্ষমতাও হারাতে বসেছেন এই প্রবীণ নারী। বার্ধক্যজনিত কারণে শরীরে দেখা দিয়েছে নানা রোগব্যাধি। আপন ভাইবোন থাকলেও তারা থাকেন প্রবাসে। তাই চাইলেও আপনজনদের দেখা পান না তিনি। যদিও মুঠোফোনে ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয়।

নীলা বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, ‘১৯৬০ সাল থেকে ধাত্রীর কাজ করেছি। কোনো দিন কেউ পুরস্কারের জন্য ডাকেনি। এখন ছেলেরা জোর করে নিয়ে এসেছে। এই বয়সে আমি হাঁটাচলা করতে পারি না। পুরস্কার দিয়ে কী করব! আমার স্বামী মারা গেছেন ২০০২ সালে। বিবাহিত জীবনে নিজের কোনো সন্তান নেই। দীর্ঘ বছর ধাত্রীর কাজ করতে গিয়ে কমপক্ষে ৮০০ শিশুর জন্মের সময় পাশে ছিলাম। আমি মনে করি তারাই আমার সন্তান। জীবনের শেষ বয়সে এসে সম্মাননা নেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। আমি শুধু প্রার্থনা করি আমার সন্তানদের জন্য। যাদের জন্ম আমার হাতে হয়েছে। তারা বেঁচে থাকুক, ভালো থাকুক, এটাই আমার শেষ চাওয়া।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জুলাই গণঅভ্যুত্থান / সংসারই চলে না, চিকিৎসার খরচ কোথায় পাবে সাইমের পরিবার?

মস্কোয় বাশারের অবস্থান নিয়ে নতুন ধোঁয়াশা

চোটে পড়ে ছয় সপ্তাহের জন্য মাঠের বাইরে আর্জেন্টাইন তারকা

১৪ দেশের নাগরিকদের ভিসা দিতে কঠোরতা

সৈয়দপুরে রাতের ফ্লাইট বাতিল, সকালে প্লেন চলাচলে বিঘ্ন

পবিপ্রবিতে কৃষি গুচ্ছের ভর্তিতে ডোপটেস্ট বাধ্যতামূলক

কেরানীগঞ্জে ৪৮৯ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার ২

৮২তম গোল্ডেন গ্লোবের মনোনয়ন ঘোষণা

সিরিয়ার মেরুদণ্ড যেভাবে ভেঙে দিচ্ছে ইসরায়েল

কিশোরগঞ্জে মাইক্রোবাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

১০

ইরান-রাশিয়ার পর এবার যুক্তরাষ্ট্রকে হটাচ্ছে তুরস্ক

১১

বাকৃবিতে ময়মনসিংহ মুক্ত দিবস পালিত

১২

র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ বিএনপির

১৩

স্ত্রীর মরদেহ হাসপাতালে রেখে পালালেন স্বামী

১৪

ঘন কুয়াশায় কমছে তাপমাত্রা, পড়বে আরও শীত

১৫

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারা গেছেন

১৬

আজ থেকে ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান নয় : আপিল বিভাগ

১৭

অর্থপাচার মামলায় তারেক রহমানের সাজা স্থগিত

১৮

সিরাজগঞ্জ কারাগারে আ.লীগ নেতার মৃত্যু

১৯

নতুন বছর শুরুর আগেই যেভাবে কমাবেন অতিরিক্ত মেদ

২০
X