এক সময়ের খরস্রোতা ঐতিহ্যবাহী তুরাগ নদ আজ যেন বিষাক্ত এক নালা। কোথাও কেমিক্যাল মেশানো দুর্গন্ধময় কালো পানির স্রোত, কোথাও ময়লা-আবর্জনার স্তূপ—সব মিলিয়ে এটি এখন এক ভয়াবহ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। নদীর বর্তমান চিত্র দেখে নতুন প্রজন্মের কাছে একে ‘নদী’ বলাটাও যেন অবান্তর—তাদের কাছে এটি যেন একটি মরা খাল।
ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন তুরাগ নদ এক সময় রাজধানী ঢাকা ও টঙ্গীর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান জলপথ ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মোগল আমলে ঢাকার শাহবন্দর ছিল তুরাগ তীরেই। ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও নদীটির ঐতিহ্য ও অতীত গৌরব নিয়ে দ্বিমত নেই কারও। তবে আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। নদীটির এমন করুণ অবস্থার জন্য দায়ী মূলত টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীর কিছু অসাধু শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
সরেজমিন দেখা গেছে, শিল্পনগরীর ভেতরকার ড্রেনেজ লাইনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিষাক্ত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তুরাগে। অধিকাংশ কারখানারই ইটিপি (এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) নেই বা থাকলেও তা সচল নয়।
স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল ইসলাম শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, এই নদীতে এক সময় রুই, কাতলা, বোয়ালসহ সব ধরনের দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। এখন শুধু পাওয়া যায় সাকার ফিশ, যেগুলো ময়লা খায়। নদীতে গন্ধে দাঁড়ানো যায় না।
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা শিরিন আক্তার বলেন, বিসিক এলাকাটা তুরাগ পাড়ে হওয়া কারখানা মালিকরা তাদের বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি সরাসরি তুরাগে ফেলে দিচ্ছেন। এতে আমাদের দেখা তুরাগ দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন এটাকে দেখলে সবাই বড়জোর ড্রেন বলেই সম্বোধন করবে। কেউ আর এটাকে নদী মানবে না।
বিসিকের ভেতরে শতাধিক ওয়াশিং ও ডাইং কারখানা রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশেরই পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব কারখানা থেকে অনায়াসেই তুরাগে ফেলা হচ্ছে রঙ, অ্যাসিড ও কেমিক্যালযুক্ত বিষাক্ত তরল বর্জ্য। অথচ এসব রিসাইকেল করার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে ইটিপি চালু থাকার কথা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা ডাইং অ্যান্ড ওয়াশের এক সাবেক শ্রমিক জানান, ইটিপি কখনোই চালু করা হয় না। মাঝেমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর আসে, তখন সাময়িক কিছু দেখিয়ে দেওয়া হয়। বাস্তবে বর্জ্য সরাসরি ড্রেন হয়ে যায় নদীতে।
এ বিষয়ে টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীর সহকারী ব্যবস্থাপক (পরিচালন) জামিল হোসাইন কালবেলাকে বলেন, আমরা এরই মধ্যে যেসব কারখানার ইটিপি নেই, তাদের চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। কেউ নির্দেশ না মানলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, শুধু চিঠি নয়, দরকার তদারকি ও কঠোর অভিযান। পরিবেশবিদদের মতে, ইটিপি ছাড়া কারখানা চালানোর অর্থ হলো পরিবেশের ওপর খোলা আঘাত। কেমিক্যালযুক্ত তরল বর্জ্য নদীর অক্সিজেন স্তর ধ্বংস করে ফেলে, ফলে পানিতে প্রাণ বাঁচে না। নদীর তলদেশে জমে থাকা ভারি ধাতব বিষক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশপাশের জমিও।
তুরাগ রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত পরিবেশকর্মী শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নদীর সঙ্গে এমন নিষ্ঠুরতা আর কতদিন চলবে? প্রশাসন চোখ বন্ধ করে রাখলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তুরাগ একেবারেই মৃত নদীতে পরিণত হবে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তুরাগ নদ আজ অবহেলার শিকার। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের একাধিকবার আশ্বাস থাকলেও বাস্তব চিত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে, তুরাগ নদ শুধুই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবে। নদী বাঁচাতে দরকার কঠোর তদারকি, অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে একটি টেকসই নদী রক্ষা পরিকল্পনা।
মন্তব্য করুন