ফেনীতে ভারি বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২০টি স্থানে ভেঙে পরশুরাম ও ফুলগাজীর কমপক্ষে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে বুধবার (৯ জুলাই) রাতে নতুন করে ফুলগাজীর মুন্সিরহাট ও আনন্দপুর ইউনিয়নে বাঁধ ভেঙে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার কমপক্ষে ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন সেখানকার মানুষজন। বন্যাদুর্গত এলাকায় বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার কিছু এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটি, মিটার ও ট্রান্সফরমার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে প্রায় ৩১ হাজার ২০০ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রেখেছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপাকে পড়েছে বানভাসি মানুষ।
ফুলগাজী উপজেলার আমজাদহাট ইউনিয়ন, ফুলগাজী সদরের কিসমত ঘনিয়ামোড়া, উত্তর শ্রীপুর, পূর্ব ঘনিয়ামোড়া, উত্তর নিলক্ষ্মী, পশ্চিম ঘনিয়ামোড়া, দেড়পাড়া, নিলক্ষ্মী, গোসাইপুর, মন্তলা, গাবতলা, কহুমা, জগতপুর এবং পরশুরাম উপজেলার ধনীকুণ্ডা, শালধর, বেড়াবাড়িয়াসহ বেশকিছু এলাকায় বন্ধ হয়ে গেছে মোবাইল নেটওর্য়াক। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন মানুষজন।
এদিকে, ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক মহাসড়কের যোগাযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বুধবার রাতে নতুন করে ফেনী ছাগলনাইয়া সড়ক দিয়ে পানি গড়িয়ে ছাগলনাইয়া উপজেলায় প্রবেশ করছে। পানিপ্রবাহ বেশি হলে এতে যে কোনো সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে ফেনীর সঙ্গে ছাগলনাইয়ার যোগাযোগ। এ ছাড়া মুহুরী নদীর পানি বুধবার রাত ৯টা পর্যন্ত বিপদৎসীমার ১৮ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, বৃষ্টিতে কোমরপানিতে তলিয়ে থাকা ফেনী শহরের পানি কমছে দ্রুত গতিতে। শহরের প্রধান প্রধান সড়কের পানি নেমে গেলেও বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার অলিগলি এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। নতুন করে পাহাড়ি ঢল শহরে ঢুকলে আবারও তলিয়ে যেতে পারে শহর। এর মধ্যে অনেক মানুষ গত বছরের ভয়াবহ বন্যার আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন। অনেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন।
ফেনীর অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী উদ্ধার তৎপরতা ও খাদ্য সহায়তায় নেমে পড়েছেন। ফেনী জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস বানভাসিদের উদ্ধার তৎপরতা, খাদ্য সহায়তা, আশ্রয় ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য মতে, পরশুরামের ১২টি ও ফুলগাজী উপজেলার ৮টিসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মোট ২০টি স্থান ভেঙে গেছে। তার মধ্যে মুহুরী নদীর ১০টি, কহুয়া নদীর ৬টি ও সিলোনিয়া নদীর ৪টি অংশে ভাঙনে অন্তত ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বুধবার রাতে নতুন করে ফুলগাজীর আনন্দপুর, ছাগলনাইয়ার রেজুমিয়া, বেতাকা, সতর এলাকায় ৬টি স্থানে বাঁধ ভাঙার খবর পাওয়া গেছে। এতে অন্তত ২০ গ্রামের পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।
বানভাসিরা জানান, গেল বছরের বন্যার বছর না ঘুরতেই আবারও পানিতে ডুবতে হয়েছে। সব জিনিসপত্র ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এ অঞ্চলে জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাঁধের ভাঙন স্থানে তীব্র স্রোতে পানি ঢুকছে। সময়ের সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গেল বছরের বন্যার মতো এবারও বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যা নিয়ে ভুগতে হচ্ছে। রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও তাদের ভাগ্য কখনো পরিবর্তন হয় না।
ফুলগাজীর স্থানীয় বাসিন্দা কবির আহমদ নাসির জানান, গত বছরের বন্যায়ও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। তারা জেনারেটরের মাধ্যমে মোবাইল টাওয়ারগুলো সচল রাখলে মানুষ খুবই উপকৃত হতো। বিশেষ করে প্রবাসীরা বেশি দুশ্চিন্তা রয়েছে।
পরশুরাম পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএম মো. সোহেল আকতার বলেন, এ উপজেলায় ৩৩ হাজার গ্রাহকের মধ্যে ৬০ শতাংশ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সংযোগ দেওয়া হবে। তবে বিদ্যুতের বিভিন্ন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সহসাই সংযোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, গতকাল ৯ জুলাই সকাল ৯টা থেকে বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) সকাল ৯টা পর্যন্ত (২৪ ঘণ্টায়) আবহাওয়া অফিস ফেনীতে বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে ৫১ মিলিমিটার। রাতে বৃষ্টি বন্ধ হলেও সকাল নাগাদ বৃষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, সময়ের সঙ্গে নদীর পানি কমেছে। ভাঙন স্থান দিয়ে পানি ঢুকে নিম্নাঞ্চলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানি কমার পরই বাঁধ মেরামতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বৃষ্টি যদি আরও না বাড়ে তাহলে দ্রুত পানি নেমে যাবে।
ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পরশুরাম, ফুলগাজী ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশে প্রায় ২০ হাজারের বেশি মানুষ দুর্যোগে পড়েছে। ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে দেড় হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। জেলার ছয় উপজেলায় ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য সাড়ে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগে পাশে রয়েছে জেলা প্রশাসন।
মন্তব্য করুন