তিস্তা ব্যারাজের কয়েকটি গেটে ফাটল দেখা দেওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে ব্যারাজের টোল আদায় বন্ধ করে ভারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কাগজে-কলমে টোল আদায় বন্ধ হলেও নিয়মতি মাসোহারা (মাসিক চাঁদা) দিয়ে ব্যারাজ পার হচ্ছে ভারী ও অতিরিক্ত পণ্যবাহী ট্রাক।
বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় আড়াইশ থেকে তিনশ অতিরিক্ত মালবাহী ট্রাক ব্যারাজ অতিক্রম করছে।
জেলার পাটগ্রাম ও বুড়িমারী স্থলবন্দর থেকে আসা পাথর ও বালুবোঝাই ট্রাক বেশি পার হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ট্রাক থেকে আদায়কৃত টাকার ভাগ হয়ে যায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, থানা-পুলিশ, ব্যারাজের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য এবং পাউবোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যারাজটি বর্তমানে সর্বোচ্চ ২০ টন ভার বহনে সক্ষম। কিন্তু প্রতিদিন ৪০ থেক ৫০ টন মালবোঝাই ট্রাক চলাচল করায় ব্যারাজ, প্রবেশ পথ ও পিলারগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের আয়ুষ্কাল।
সরেজমিন তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে দেখা যায়, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ব্যারাজের ওপর দিয়ে পার হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টন পণ্যবোঝাই ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন। রাত যত গভীর হয় পণ্যবোঝাই যান পারাপারের সংখ্যাও বেড়ে যায়। প্রতিদিন আড়াইশ থেকে তিনশ অতিরিক্ত পণ্যবাহী ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন ব্যারাজ অতিক্রম করছে। ব্যারাজের আশপাশের একাধিক দোকানদার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি ওভারলোড ট্রাক নিয়মিত মাসিক চাঁদা দিয়ে ব্যারাজ পার হয়। অন্যান্য যানবাহনের চালকদের কাছ থেকে নগদ তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা আদায় করা হয়। আবার অবৈধ পণ্য পার হলে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবে বিভিন্ন উপায়ে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় হয়। আর অতিরিক্ত গণ্যবাহী ট্রাক থেকে মাসে আদায় করা হয় পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা।
ব্যারাজের পাশেই পুলিশ ফাঁড়ি। পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি দায়িত্বে রয়েছেন আনসার সদস্যরাও। ব্যারাজ থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলাধীন মহাসড়ক থেকে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে যাওয়ার মোড়ে রয়েছে হাইওয়ে থানা। ওই হাইওয়ে থানা থেকে তিস্তা ব্যারাজ পার হয়ে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড পর্যন্ত রয়েছে সিসি ক্যামেরা, যা নিয়ন্ত্রণ করছে হাইওয়ে থানা পুলিশ ও পাউবো অফিস। প্রশ্ন উঠেছে, সিসি ক্যামেরা, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন পার হচ্ছে!
এদিকে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুটি স্কেল বছরের পর বছর অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এটি সচল থাকলে ২০ টনের বেশি গাড়ি পার হতে পারবে না। পাউবোর অসাধু কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে স্কেল মেরামত আটকে রেখেছেন।
২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে ব্যারাজের ২৪, ২৭ ও ২৮ নম্বর গেটে ফাটল দেখিয়ে তৎকালীন প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান ভারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকেই প্রায় একযুগ ধরে আওয়ামী লীগের নেতারা পণ্যবাহী যান থেকে টাকা ওঠানো ও ভাগবাটোয়ারার কাজ করতেন।
টাকার ভাগ যেত সাবেক সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন, তার ছেলে মাহমুদুল হাসান সোহাগ এবং হাতীবান্ধা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে শ্যামলের কাছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর চাঁদা আদায় হাতবদল হয়। বর্তমানে সরাসরি চাঁদা আদায় করছেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। আর নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা।
একজন ট্রাকচালক কালবেলাকে বলেন, ‘টাকা ছাড়া ব্যারাজে পাথরবোঝাই গাড়ি তোলা সম্ভব নয়। মাসিক ২ হাজার টাকার বিনিময়ে তিস্তা ব্যারাজের ওপর দিয়ে পাথরবোঝাই ট্রাক চলাচল করে। তিস্তা ব্যারাজ হয়ে চলাচল করলে তিস্তা সড়ক সেতুর টোল ও অতিরিক্ত জ্বালানি দুটোই বেঁচে যায়।’
তিস্তা ব্যারাজের পাশে মুদি দোকানদার আব্দুল কাদের ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আয়নাল হোসন জানান, ব্যারাজে আনসার সদস্য ও পুলিশ দিনরাত দায়িত্বে থাকে। এরপরও কীভাবে ওভারলোড ট্রাক ব্যারাজ পার হয়! সিসিটিভি ক্যামেরা, আনসার ব্যাটালিয়ন ও পুলিশের সামনে দিয়েই অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন ব্যারাজ অতিক্রম করছে।
তবে তিস্তা ব্যারাজের নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা দোয়ানি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এরশাদুল হক ট্রাকপ্রতি উৎকোচ গ্রহণের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘নিয়মমতে ২০ টনের অধিক পণ্যবোঝাই যান চলাচলের সুযোগ নেই। আমরা চলি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে। তাদের অনুমতি ছাড়া কোনো কিছুই করার ক্ষমতা নেই।’
হাতিবান্ধা হাইওয়ে থানার ওসি আবু সাঈদও ট্রাকপ্রতি মাসিক চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘তিস্তা ব্যারাজের ওপর দিয়ে ২০ টনের অধিক নয়— এমন যানবাহন পারাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অনুমতি দেওয়া আছে। এর অধিক পণের যানবাহন চলাচল যেন করতে না পারে, এজন্য সার্বক্ষণিক হাইওয়ে থানা পুলিশ টহল দিচ্ছে।’
ডালিয়া পাউবোর (যান্ত্রিক) নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যারাজের ওপর দিয়ে সর্বোচ্চ ২০ টন পর্যন্ত পরিবহন পারাপারের সুযোগ আছে। এরই মধ্যে দুটি স্কেল সংস্কারের চাহিদা দেওয়া হয়েছে।’
আরেক নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ‘ব্যারাজ দিয়ে ভারী গাড়ি চলাচলের কোনো সুযোগ নেই।’ চাঁদা আদায় ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন, ‘নিষ্কাশন খাল সংস্কারের জন্য ৩৫টি প্যাকেজে কাজ চলছে। এর মধ্যে ১০টি শেষ হয়েছে। জমি উদ্ধারে বাজেট প্রাপ্তির পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
‘রিভারাইন পিপল’-এর সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হাক্কানী বলেন, তিস্তার প্রবাহ ঠিক না থাকায় প্রতি বছর বন্যায় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ব্যারাজের ওপর দিয়ে ওভারলোড গাড়ি চলাচল ও নানা অনিয়মে লালমনিরহাট-কুড়িগ্রামসহ পুরো অঞ্চল ঝুঁকিতে পড়ছে। কর্তৃপক্ষের এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার কালবেলাকে বলেন, ‘তিস্তা ব্যারাজের ওপর দিয়ে ২০ টনের বেশি পণ্যবোঝাই যানবাহন চলাচলের কথা জেনেছি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ তিস্তা ব্যারাজ রক্ষায় শিগগির ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।’
মন্তব্য করুন