ধূপের গন্ধে আর ঢাকের তালে মুখর চট্টগ্রামের গোলপাহাড় মহাশ্মশান ও কালী মন্দিরের আঙিনা। সাদা-লাল শাড়িতে নারীরা, কাঁসার থালায় ফুল আর প্রদীপ সাজাচ্ছেন। ছেলেরা রঙিন কাপড় টাঙাচ্ছে। সেই ব্যস্ততার ভেতরেই হাজির হলেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। সঙ্গে কর্মকর্তারা, মুখে শুভেচ্ছার হাসি।
মন্দির প্রাঙ্গণে বসে স্থানীয় সনাতন সম্প্রদায়ের নেতারা জানালেন—এ বছরে দুর্গাপূজার সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে উৎসবের দিনগুলোয় আরও পুলিশি টহল, সিসিটিভি ও স্থানীয় সহযোগিতার দাবি তুললেন তারা। খালিদ হোসেন মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তাদের কথা।
মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে তিনি চট্টগ্রামের গোলপাহাড় মহাশ্মশান ও কালী মন্দির পরিদর্শন করেন। দুর্গাপূজার আগে নিরাপত্তা ও সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সনাতন সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
তিনি বলেন, ‘যারা উপাসনালয় অপবিত্র করতে চায় বা পাথর নিক্ষেপ করে, তারা অপরাধী। তাদের কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে, এটা অনেকটা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে এই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ কেউ বিনষ্ট করতে না পারে।’
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে তিনি পরামর্শ দিলেন, ‘মণ্ডপে সিসি ক্যামেরা বসান। রাতের বেলায় হামলার ঘটনা ঘটে। অন্ধকারের ফাঁকে ঢিল মারা হয়। আশঙ্কা থাকলে হটলাইনে ফোন দিন, মুহূর্তের মধ্যে প্রশাসন পাশে দাঁড়াবে। স্থানীয় মানুষদেরও যুক্ত করুন। যে ধর্মের মানুষই হোক, তাদের সহযোগিতা নিন। তাহলে দুর্গাপূজা উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপন করা যাবে।’
ধর্ম অবমাননা প্রসঙ্গে খালিদ হোসেন বলেন, ‘কেউ যদি ধর্ম অবমাননা, কটূক্তি বা ব্যঙ্গ করে—তার দায় ওই ব্যক্তির। সম্প্রদায় দায়ী নয়। কিন্তু আমরা অনেক সময় আইন হাতে তুলে নিই, হামলা, মামলা, লুটপাট করি। আইন হাতে নিলে আইনের শাসন নষ্ট হয়ে যায়। অপরাধের শাস্তি হবে, কিন্তু তার জন্য নিরপরাধ মানুষের বাড়িঘর আক্রান্ত হতে পারে না।’
তিনি সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গেও সতর্কবার্তা দিলেন, ‘যারা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি রাখেন, তাদের মানবিকতা থাকে না। অসাম্প্রদায়িক মানুষের ভেতরে থাকে। আমি যখন কোনো অভাবগ্রস্ত, অসুখী, দুঃখী মানুষ দেখি, আমি তার ধর্ম জানতে চাই না। সে যে মানুষ—এটাই আমার কাছে বড়। আমরা মানবতার জয়গান গাইতে চাই। ধর্ম যার যার, সে পালন করবে। এই দেশ আমাদের সবার। আমরা প্রত্যেকে নির্বিঘ্নে ধর্মীয় উৎসব-উপাসনা চালিয়ে যাব। আমরা চাই, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যের রোল মডেল হিসেবে দুনিয়াতে পরিচিত হোক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী অনেক দেশ আছে। তার তুলনায় আমরা এটাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই। কেউ যদি কোনো অপরাধ করে থাকে সেই অপরাধের জন্য ব্যক্তি দায়ী হবে, সম্প্রদায় নয়। নানা ধর্ম, নানা বর্ণ, নানা জাতির মানুষের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে। আমি আমার ধর্ম পালন করব, অন্যরা যাতে নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে সেই সুযোগও করে দিতে হবে।’
মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান ও নৃগোষ্ঠীর মানুষ—সবাই যাতে নিরাপদে নিজ নিজ ধর্মচর্চা করতে পারে, সেটি সাংবিধানিক অধিকার বলেও উল্লেখ করেন ধর্ম উপদেষ্টা। তিনি জানান, নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা নিশ্চিত করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছি। স্বাধীন, সার্বভৌম এ বাংলাদেশই আমাদের ঠিকানা। আমরা এ দেশকে ভালোবাসি। এ দেশের অর্জনে নানা ধর্ম, নানা বর্ণ, নানা জাতির মানুষের অবদান আছে। আমরা কারও অবদানকে খাটো করতে চাই না।
নিউইয়র্ক সফরের আগে প্রধান উপদেষ্টা দুর্গাপূজা বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন বলেও জানালেন খালিদ হোসেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওনি যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে বলে গেছেন, আমার আসতে আসেত তো দশমী হয়ে যাবে। ওনি বললেন, তুমি সতর্ক থাকো। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপ করে যাতে মানুষ নির্বিঘ্নে পূজাটা উদযাপন করতে পারে, এজন্য রাতদিন পরিশ্রম করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি দীপক কুমার পালিত, গোলপাহাড় মহাশ্মশান ও মন্দির পরিচালনা পরিষদের সভাপতি দোদুল কুমার দত্ত, সাধারণ সম্পাদক বিশ্বনাথ দাশ বিশু, সহসভাপতি নিকেল দে, লেলিন পাল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুনমুন দত্ত মুন্না, অমলকৃষ্ণ নাথ টুটুল, রুভেল দে, চন্দন মহাজন, মিহির দে এবং এবং মন্দির কমিটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন