ঢাকার ধামরাইয়ে শ্রী শ্রী যশোমাধব দেবের ৩৫২তম ঐতিহাসিক রথোৎসব শুরু হচ্ছে মঙ্গলবার (২০ জুন)। যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রথোৎসব। ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে রথোৎসব শুরু হবে। আগামী ২৮ জুন উল্টোরথের মাধ্যমে রথযাত্রার ইতি ঘটলেও রথমেলা চলবে মাসব্যাপী।
ধামরাইয়ে শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথ এশিয়া উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। এই ঐতিহ্যবাহী রথ উৎসবকে কেন্দ্র করে গোটা ধামরাইয়ে এখন সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। মেলায় শত শত স্টল বসেছে। ৪১ ফিট উঁচু কাঠের তৈরি এই রথের যাবতীয় সাজ-সজ্জার কাজ সম্পূর্ণ করেছে শ্রী শ্রী যশোমাধব মন্দির ও রথোৎসব পরিচালনা কমিটি।
মূলত সনাতন হিন্দু ধর্মীয় ভাবধারা ও অনুভূতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও জাতি ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণিপেশা, ধনী-গরিব নির্বিশেষে এ রথমেলা সব মানুষের মহামিলন মেলায় পরিণত হয় প্রতি বছরই। রথের রশি ধরে টানছেন, আনন্দ বিনিময় করেছেন, এই সাম্যই রথযাত্রার মূল শিক্ষা।
ধামরাইয়ের শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের রথযাত্রার ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা ১০৭৯ সালে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১২০৪ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১২৫ বছর পর্যন্ত রথযাত্রা চলে এসেছে। তারপর বালিয়াটি জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় রথযাত্রা অব্যাহত থেকেছে আরও ১৪৬ বছর। বাংলা ১৩৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপের পর মির্জাপুরের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা এগিয়ে আসেন রথযাত্রার উৎসব আয়োজন যা আজও অব্যাহত আছে। তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি শ্রী রাজীব প্রসাদ সাহা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির কমিটির সহযোগিতায় শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের সেবা ও রথ পরিচালনায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
এই রথ উৎসব হিন্দু ধর্মীয় ভাবধারায় প্রায় ৪০০ বছর পূর্ব হতে শুরু হলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ফলে এই উৎসব ব্যাপকভাবে সার্বজনীনতা লাভ করেছে। এই ধর্মীয় রথ উৎসবকে কেন্দ্র করে ইতিহাস খ্যাত ধামরাইয়ে বেড়ানোর জন্য প্রতিটি বাসগৃহে দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন এসে ভিড় করে। অতীতে বাংলাদেশ নয়, বিদেশ থেকেও হাজারও ভক্ত রথ উৎসবকে কেন্দ্র করে ধামরাইয়ে এসে সমাগত হতো। এখনো পূর্বের ন্যায় আসেন ভক্তরা। পুরো উৎসবটিই কালের বিবর্তনে এখন ধর্মীয় ভাবধারা নয় সার্বজনীন মিলনমেলা বা স্রোতধারায় প্রভাবিত হচ্ছে।
এবার রথযাত্রার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও ঢাকা-২০ এর সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা বেনজীর আহমদ ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার মান্যবর শ্রী প্রণয় কুমার ভার্মাসহ আমন্ত্রিত অতিথি, যশোমাধব মন্দির পরিচালনা ও রথ কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) জীবন কানাই দাস, শ্রী শ্রী যশোমাধব মন্দির পরিচালনা ও রথ কমিটির সাধারণ সম্পাদক কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও প্রয়াত বিশিষ্ট দানবীর আরপি সাহার পৌত্র (নাতিরাজিব প্রসাদ সাহা) প্রমুখ।
ধামরাই যাত্রাবাড়ী শ্রী শ্রী যশোমাধব মন্দিরের মেলাঙ্গনের মাধব মন্দির মাঠ, কায়েতপাড়াস্থ শ্রী শ্রী যশোমাধব মন্দির ও ঐতিহাসিক শ্রী শ্রী যশোমাধব দেবের রথ মন্দির কমিটির উদ্যোগে সংস্কার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কমিটির সহসভাপতি প্রভাষক ডা. অজিত কুমার বসাক।
রথ উৎসব উপলক্ষে কায়েতপাড়াস্থ রথ খোলায় ও রথের সামনে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হবে। এ সময় ডাক ঢোল কাঁসর ঘণ্টা ও মহিলাদের উলুধ্বনিতে মাধব মন্দিরের বর্তমান প্রধান পুরোহিত উত্তম কুমার গাঙ্গুলী ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবেন। দুপুরে মাধব মন্দিরে ভোগ রাগের পর প্রসাদ বিতরণ করা হবে আগত হাজারও ভক্তের মাঝে।
বিকেলে রথের সামনে লাখো ভক্তের উপস্থিতিতে উদ্বোধনী আলোচনা সভা শেষে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে রথটানা হবে বলে জানান মন্দির কমিটির দপ্তর সম্পাদক ও ধামরাই উপজেলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সহসভাপতি সাংবাদিক রনজিত কুমার পাল (বাবু)।
বিকেল ৪টায় মাধব মন্দির থেকে মাধব বিগ্রহসহ অন্যান্য বিগ্রহগুলো নিয়ে এসে সারা বছর যেখানে রথটি থাকে সেই রথ খোলায় রথের ওপর মূর্তিগুলো স্থাপন করা হবে। এর পর বিকেল ৪টার দিকে রথের শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান রথখোলায় অস্থায়ীভাবে স্থাপিত মে অনুষ্ঠিত হবে।
অনুষ্ঠানের আলোচানা সভা শেষে প্রধান অতিথি রথ উৎসবের পুরোহিত হাতে প্রতীকী রশি প্রদানের মাধ্যমে রথ টানার আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করবেন। এই রথটি মূর্তি সমেত লাখো ভক্ত নর-নারী পাটের রশি ধরে কায়েতপাড়ার রথ খোলা থেকে প্রধান সড়ক দিয়ে টেনে পৌর এলাকার গোপন ঘরে নেয়া হবে। এখানেই রথটি প্রতি বছরের ন্যায় ৯ দিন অবস্থান করবে। মাধব ও অন্যান্য বিগ্রহগুলো রথ থেকে নামিয়ে নিয়ে ৯ দিন পূজারীদের দ্বারা পূজিত হবে কথিত মাধবের শ্বশুরালয় যাত্রাবাড়ি মন্দিরে। ৯ দিন পর আগামী ২৮ জুন অনুষ্ঠিত হবে উল্টো রথযাত্রা উৎসব। পূর্বের ন্যায় মাধব ও অন্যান্য দেব-দেবী বিগ্রহ রথে চড়িয়ে ২৮ জুন বিকেল ৬টায় টেনে আনবে পূর্বের স্থান ধামরাই পৌর এলাকার কায়েতপাড়াস্থ রথখোলায়। এখান থেকে মূর্তিগুলো চলে যাবে পুরোনো মাধবের নিজ আলয় মন্দিরে। রথ খোলায় রথটি সারা বছর রাখে বলে এই স্থানটির নামকরণ হয়েছে রথ খোলা ময়দান।
যশোমাধব মন্দির পরিচালনা পর্ষদের দপ্তর সম্পাদক সাংবাদিক রনজিত কুমার পাল বলেন, ধামরাইয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথোৎসব মাসব্যাপী চলবে। আগামী ২০ জুন রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে এবং ২৮ জুন উল্টোরথের মাধ্যমে রথযাত্রার ইতি ঘটবে।
রথযাত্রার সর্বশেষ প্রস্তুতির বিষয়ে ধামরাই যশোমাধব মন্দির পরিচালনা পর্ষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নন্দ গোপাল সেন বলেন, ‘রথযাত্রা ও রথমেলা উপলক্ষে রথের সাজসজ্জা ও পরিচর্যার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। রঙের কিছু কাজ চলছে। বাকি কাজও দ্রুত শেষ হবে। এরপর রথটান হবে। এ ছাড়া মাসব্যাপী মেলা হবে। এর মধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।’
যশোমাধাব মন্দির পরিচালানা ও রথ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও কুমুদিনি ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা (আর পি) সাহার পৌত্র রাজিব প্রসাদ সাহা বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও রথ উৎসব ও মেলার সার্বিক আয়োজন যথেষ্ঠ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। রথ উৎসব ও মন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে পৌর এলাকাসহ ধামরাইয়ের একটি পৌরসভা ও ১৬টি ইউনিয়নেই সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। উৎসবমুখর পরিবেশের রূপ লাভ করেছে। রথ কমিটি কর্তৃক ২২২ সদস্য বিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক দল গঠিত হয়েছে।
ধামরাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হারুন অর রশিদ বলেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় সব জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করা থাকবে।
মন্তব্য করুন