বান্দরবানের লামায় হাইকোর্টের আদেশেকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে অবৈধ ৪০টি ইটভাটায় এক্সকেভেটর দিয়ে দিনে রাতে দেদার চলছে পাহাড় কাটা। পাহাড়ে বর্ষায় সবুজ প্রকৃতি সাজতে শুরু হলেও সেই পাহাড়ের বুকে আঘাত শুরু করেছে এই ইটভাটার মালিকরা। উপজেলার অন্তত অর্ধশতাধিক ইট ভাটায় মাটির জোগান দিতে সাবাড় করা হচ্ছে অসংখ্য পাহাড়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফাইতং ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডে গড়ে উঠেছে ৩০টি ইটভাটা। চলমান বর্ষার শুরু থেকে ইটভাটাগুলো এক্সকেভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে মৌসুমের জন্য মাটি মজুদ করেছে। হাইকোর্টের নির্দেশে অবৈধ এই ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এমন সাইনবোর্ড বাইরে ঝুলিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনের চোখে ফাঁকি দিতে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে পাহাড় কাটা শুরু হয় যা চলে ভোর পর্যন্ত। ভেসে উঠেছে পাহাড়ের ক্ষত চিহ্ন। প্রায় ২৫ একর পাহাড় কেটে সাবাড় করা হয়েছে। এ যেন পাহাড় কাটার উৎসবে মেতেছে ইটাভাটা মালিকরা। সে সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় থাকা বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা নিধন করে ফেলছে। প্রকৃতির বুকে মানুষের এমন আচরণের কারণে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে।
হাইর্কোটের নির্দেশে ইটভাটা বন্ধ ঘোষণা করার পরে ও কীভাবে পাহাড়ের মাটি কাটছেন এমন প্রশ্নের জবাবে
এফ এ সি ইটভাটার মালিক জাফর আলী বলেন, উপর মহল থেকে নির্দেশনা পেলে ইটভাটাগুলো পুনরায় চালু হবে এজন্য এখন থেকে মাটি কেটে প্রস্তত করে রাখছি। ইটভাটাগুলো শহরে করতে পারতাম মাটির জোগান দিতে পাহাড়ে করেছি। পাহাড় থেকে মাটি কেটে আনার সময় প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাইকে ম্যানেজ করতে হয়। ইটভাটায় মাটি কাটার জন্য ডিসি, ইউ এনও থেকে শুরু করে ওসি পর্যন্ত সবাই বলে টাকা দাও। ইটভাটায় মাটি কাটা অপরাধ। তাই টাকা দিয়ে সবাইকে ম্যানেজ করে ইটভাটা পরিচালনা করছি। প্রতিবেদককে বলেন, আপনিও ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মোক্তার মেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু টাকা নিয়ে যান।ফাইতং ইউনিয়নের বাসিন্দা ও ইটভাটা ম্যানেজারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফাইতং এলাকা এক প্রকার প্রতিযোগিতা করে পাহাড়গুলো কাটছেন এই ইটভাটা মালিকরা। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ওয়াইএসবি ইটভাটার মালিক ও ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি এবং ওই ইউনিয়নের সাবেক সদস্য (মেম্বার) মোক্তার হোসেন। সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেন ও ঝিকঝাক ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও মানিকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিম এই তিনজনের নেতৃত্বে ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে টাকা তুলে সে টাকা দিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ও জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেছেন ফলে তেমন অভিযান চালানো হয় না। মাঝেমধ্যে আসেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দুই-একটি ইটভাটাকে জরিমানা করে চলে যান। চলে যাওয়ার পর দিন থেকে আবার পাহাড় কাটা শুরু হয়। এখনও পর্যন্ত পাহাড় কাটা অব্যাহত আছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আল আমিন ও মো. জসিম জানিয়েছে, গত তিন মাস ধরে এখানে পাহাড় কাটা অব্যাহত আছে। আশপাশের কয়েকটি পাহাড়ের মাটি কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে। শুধু এই বছর নয়, কয়েক বছর ধরে কাটতে কাটতে অনেকগুলো পাহাড় এখন প্রায় শেষ হওয়ার পথে। যেভাবে দিন-রাত অবিরাম পাহাড় কাটা হচ্ছে, তাতে কিছুদিন পর পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকবে না। ইটভাটার মালিকেরা প্রভাবশালী স্থানীয়রা প্রতিবাদ করতে গেলে মামলা-হামলার হুমকি দেওয়া হয়। এজন্য কেউ সাহস করে না। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এজন্য পাহাড় কাটা এখনো বন্ধ হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মোক্তার হোসেন ইটভাটাগুলোতে মাটি কাটার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ইটভাটাগুলো হাইকোর্টের নির্দেশে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে তাই এ বছর ইটভাটার কার্যক্রম চালাতে পারবে কিনা নিশ্চিত না। তবে সামনের জন্য ইটভাটা প্রস্তুত করে রাখতে হচ্ছে। এজন্য মাটির জোগান দিতে পাহাড়ের কিছু অংশ কাটা হয়েছে।
ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেন বলেন, পাহাড় কম বেশি সব ইটভাটার মালিক কাটেন। কিন্তু আমার নেতৃত্বে কাটা হচ্ছে কথাটা মিথ্যা। পাহাড় যেটা কাটা হচ্ছে সেটা অবৈধ। কিছু টাকা সাশ্রয় করতে পাহাড়গুলো কাটছেন ইটভাটা মালিকরা।
ঝিকঝাক ইটভাটা মালিক সমিতি সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান মো. আজিম বলেন, আমার নেতৃত্বে পাহাড় কাটা হচ্ছে বিষয়টি মানহানীকর ও বিভ্রান্তিমূলক। কোনো ইটভাটা মালিক যদি পাহাড় কাটেন সে দায় তার।
পাহাড় ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না জানতে চাইলে লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, ফাইতং ইউনিয়নে ইটভাটার মালিকরা পাহাড় কাটছে বলে অবগত হয়েছি। পার্বত্য এলাকার সবগুলো ইটভাটা হাইকোর্টের নির্দেশে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করি। অভিযানের সময় পাহাড় কাটার প্রমাণ পেলে জরিমানা করা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে পাহাড় কাটা হচ্ছে ইটভাটা মালিকদের এমন দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহমেদ, তাদের এমন দাবি মিথ্যা। আমরা আগেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছি, জরিমানা করেছি। কোনোভাবেই থামাতে পারছি না। তারপরও যতটুকু পারছি ব্যবস্থা নিচ্ছি। সরেজমিনে তদন্ত করে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
মন্তব্য করুন