মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার শাকরাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে অনিয়ম ও শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছে অত্র বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সদস্য, শিমুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের সহযোগী ঠিকাদার মোহাম্মদ আলী চৌধুরী (টুলুর) বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছয়শর বেশি শিক্ষার্থীর জন্য জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশের চারতলা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা নির্মাণের জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৫ লাখ ৫ হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ দেয় শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তর সাভার জোন, ঢাকা।
সব প্রক্রিয়া শেষে নির্মাণের জন্য তিনশ দিন সময়সীমা বেঁধে দেয় সংশ্লিষ্ট দপ্তর। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় তলা ও তৃতীয় তলার নির্মাণকাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাদিয়া কন্সট্রাকশন।
কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাদিয়া কন্সট্রাকশনের ভবন নির্মাণের কাজ চালিয়ে যান মোহাম্মদ আলী চৌধুরী টুলু ও তার লোকজন। বিষয়টি বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষকদের নজরে আসলে তারা টুলু মিয়ার কাছে জানতে চান কাজের ব্যাপারে। ওই সময় টুলু মিয়া ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষকদের জানান, ঠিকাদারের থেকে তিনি কাজটি কিনে নিয়েছেন।
পরে কাজের ধীরগতি ও নিম্নমানের কাজের বিষয়ে ম্যানেজিং কমিটি বারবার সহযোগী ঠিকাদারকে অবগত করলে তিনি কোনোকিছু পাত্তা না দিয়েই স্থানীয় ও সরকার দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তার মতো করে চালিয়ে যান কাজ।
উপায়ন্ত না পেয়ে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বিষয়টি জেলা কমিটির মাসিক সভায় উপস্থাপন করেন। বিষয়টি উপস্থাপনের পর গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ে ভবনের কাজে অগ্রগতি পরিদর্শনে আসেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাসহ শিক্ষা অধিদপ্তরের অন্যান্য কর্মকর্তা ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পরিদর্শনে আসায় সবার উপস্থিতিতে ক্ষিপ্ত হয়ে সহযোগী ঠিকাদার মোহাম্মদ আলী চৌধুরী টুলু বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সুশীল কুমার সাহাকে অকথ্য ভাষায় গাল-মন্দ করেন ও তার লাশ ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন।
এ বিষয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ওই প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বরাবর সহযোগী ঠিকাদার মোহাম্মদ আলী (টুলুর) উগ্র ও অসদাচরণের জন্য লিখিত অভিযোগ দেন।
সম্প্রতি সময়ে চলতি মাসের ১৭ তারিখে স্থানীয় ওই সহযোগী ঠিকাদার ৩০/৩৫ জনের দলবল নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কক্ষে প্রবেশ করে সহকারী শিক্ষক মহিদুর রহমানকে দাড় করিয়ে রেখে তার কাছে বিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র দেখতে চান।
ওই শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত দেখানো যাবে না এই কথা বললে, তাকে মারধর করার, ভয়ভীতি দেখানোসহ নানা হুমকি-ধমকি দেয় মোহাম্মদ আলী চৌধুরী টুলু। ওই ঘটনার ভিডিও ঠিকাদার গত ১৯ তারিখে ফেসবুকে শেয়ার করে। যার ভিডিও লিংক কালবেলার হাতেও রয়েছে।
গত ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে সদ্য অবসরে যাওয়া বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক সুশীল কুমার সাহা তার সঙ্গে ঠিকাদারের উগ্র ও অসদাচরণের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এ বিষয়ে সভাপতি বরাবর আমি একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তবে প্রভাবশালী স্থানীয় ঠিকাদার মোহাম্মদ আলী টুলুর বিষয়ে কোনো কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মহিদুর রহমান তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, আমরা শিক্ষক মানুষ, মানসম্মানের ভয়ে চেপে যেতে হয় আমাদের। এখানে আমাকে আসতে হয় দূর থেকে। যেহেতু শিক্ষকতার সঙ্গে আমার আর পরিবারের রুটি রুজির সম্পর্কও আছে। চাইলেও অনেক সত্য কথা বলতে পারি না। ঠিক আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা অনেকটা বাধ্য হয়েই মানসম্মানের ভয়ে চেপে যেতে হয়েছে আমাকে।
বিদ্যালয়ের সদস্য সচিব ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আ. রহিম বলেন, চার বছর অতিবাহিত হয়ে পাঁচ বছর হতে চলেছে, এখনো কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। ভবনটিও বুঝে পাচ্ছি না। শ্রেণিকক্ষ সংকট থাকায় বিদ্যালয়ের শিক্ষা-কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া দৃশ্যমান দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার ওয়ালে এরমধ্যে ড্যামেজ হয়ে গেছে। ইটবালু খোয়া খুলে পড়ছে। এ ছাড়া অনেকগুলো বেঞ্চ ও ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, শুনেছি এর আগে সবার উপস্থিতিতে সাবেক প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে অসদাচরণ করেছেন স্থানীয় ঠিকাদার মোহাম্মদ আলী চৌধুরী টুলু। তবে সেদিন আমি ব্যক্তিগত কাজে বাইরে থাকায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না। এ ছাড়াও এরমধ্যে সহকারী শিক্ষক মহিদুরের সঙ্গেও দলবল নিয়ে বিদ্যালয় কক্ষে প্রবেশ করে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন স্থানীয় ওই ঠিকাদার।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউর রহমান খান (জানু) বলেন, স্থানীয় সহযোগী ঠিকাদার মোহাম্মদ আলী টুলুর সন্ত্রাসী স্টাইলের কার্যকলাপের কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আতঙ্কের মধ্যে আছে। তাকে বারবার সতর্ক করার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু তিনি কোনো কিছুই আমলে নিচ্ছেন না। স্থানীয় প্রভাব বিস্তার করে একের পর এক অঘটন ঘটিয়ে যাচ্ছে। তার এমন আচরণের কারণে ইতোমধ্যে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষদের নিয়ে মিটিং করে রেজুলেশন পাস করা হয়েছে। যদি কেউ বিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে শিক্ষকদের হেনস্থা করা চেষ্টা করে তাহলে প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এ ব্যাপারে শিবালয় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের বলেন, দীর্ঘদিন আগে ওই ঠিকাদার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে অসদাচরণ করেছিলেন। তবে সম্প্রতি সময়ে সহকারী শিক্ষকের সঙ্গে অসদাচরণের বিষয়ে তিনি জানেন না। শাশুড়ি খুবই অসুস্থ আমি এখন গাড়িতে আছি এ বিষয়ে পড়ে কথা হবে বলে ফোনটি কেটে দেন ওই শিক্ষা কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন বলেন, শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণের ব্যাপারে অবগত নই। তবে শিক্ষকদের সঙ্গে এরকম কোনো ঘটনা ঘটলে জেলা শিক্ষা প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলে, ওই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ও শিক্ষদের নিরাপত্তায় সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন