কুড়িগ্রামের উলিপুরে তিস্তার চরাঞ্চলের মানুষের কৃষিপণ্য পরিবহনে একমাত্র ভরসা ঘোড়ার গাড়ি। রাস্তাঘাট না থাকায় অধিকাংশ ঘোড়ার গাড়িচালকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ছুটে বেড়াচ্ছেন এ চর থেকে ওই চরে। ফলে চরের উৎপাদিত কৃষি পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখছে এ ঘোড়ার গাড়ি।
বর্তমান যুগে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের জন্য যান্ত্রিক গাড়ির ওপর সবাই নির্ভরশীল। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে যান্ত্রিক গাড়ি এখনকার মানুষের একমাত্র ভরসা। কিন্তু তিস্তার প্রত্যন্ত চরে দেখা মিলে অযান্ত্রিক অসংখ্য ঘোড়ার গাড়ির। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের মানুষের পণ্য পরিবহন, অসুস্থ রোগীকে বহন এবং যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় ঘোড়ার গাড়িকে।
জানা যায়, চরাঞ্চলে যান্ত্রিক যানবাহন না থাকায় আগের দিনের মানুষ প্রচণ্ড গরমে উত্তপ্ত বালুতে পায়ে হেঁটে অনেক পথ পাড়ি দিত এবং নিজেদের উৎপাদিত পণ্যগুলো মাথায় অথবা লাঠিতে করে ঘাড়ে নিয়ে বহন করত। কিন্তু ঘোড়ার গাড়ি উদ্ভাবনের পর চরাঞ্চলের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহনসহ ব্যবসায়ীদের পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য একমাত্র মাধ্যম হিসেবে গাড়িটি ব্যপক ভূমিকা রাখছেন।
উলিপুর উপজেলা চর এবং নদীবেষ্টিত এলাকা। উপজেলার তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদ অন্যতম। বর্ষার সময়ে এই নদ-নদী তাদের চিরোচেনা রূপ-যৌবন ফিরে পায়, পানিতে তলিয়ে যায় প্রত্যন্ত চরের নিম্নাঞ্চল। এসময় চরবাসীর একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে থাকে নৌকা। তবে শুকনো মৌসুমে যাতায়াতের একমাত্র প্রধান মাধ্যম ঘোড়ার গাড়ি। আর প্রত্যন্ত এসব চর এলাকার অনেক মানুষ ঘোড়ার গাড়ি দিয়েই তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন।
স্থানীয়রা জানান, তিস্তার চরাঞ্চালে শুকনো মৌসুমে নদীতে পানি কমে যায় এবং বিশাল এলাকাজুড়ে চর জেগে উঠে। চরে যাতায়াতের জন্য যান্ত্রিক গাড়ি, ভ্যান, রিকশা, অটো, মাইক্রো চলাচল একেবারেই অসম্ভব। তাই এই এলাকার যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে ঘোড়ার গাড়ির ব্যাপক ব্যবহার হয়।
চরাঞ্চলের রাস্তাঘাটগুলো তেমন উন্নত না হওয়ায় এখানে যান্ত্রিক গাড়ি চলে না তাই চরবাসীকে নানা সময় পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। এসব সমস্যাকে উপেক্ষা করে তাদের নিত্যদিনের কাজ পরিচালনার জন্য তারা ব্যবহার করেন অযান্ত্রিক ঘোড়ার গাড়ি। এই গাড়ি কৃষকদের পণ্য পরিবহন, অসুস্থ মানুষদের উপজেলা স্বস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকা ঘাটে পৌঁছে দেওয়া, চরাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া এবং চরবাসীর অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।
উপজেলার তিস্তার গোড়াইপিয়ার চরাঞ্চলের ঘোড়াগাড়ি চালক শফিকুল ইসলাম বলেন, তিস্তার চরাঞ্চলে সবসময় বিভিন্ন ধরনের চাষাবাদ হয়েই থাকে। বর্তমান আলুর চাষ হয়েছে। বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে ঘোড়ার গাড়ি করে বস্তা প্রতি ৩০ টাকা দরে ঘাট পাড়ে পৌঁছে দেই। এভাবে দিনে প্রায় ৫০ বস্তা পর্যন্ত ঘাট পাড়ে নিয়ে আসা যায়। তাতে প্রতিদিন আয় করি ১ হাজার থেকে ১৫শ টাকা। ঘোড়ার খাওয়ার জন্য প্রতিদিন খরচ হয় ২৫০ টাকা। বাকি টাকা দিয়ে আমার সংসার ভালোই চলছে।
ঘোড়ার গাড়ি চালকদের মধ্যে মকবুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, আব্দুল করিম মিয়া, আনিছুর রহমান ও আসাদুল ইসলামসহ আরও অনেকে বলেন, তিস্তার চরে ৪-৫ মাস চলে বহনের কাজ। মে মাসের মাঝামাঝি তিস্তা নদীতে পানি এলে বন্ধ হয়ে যায় ঘোড়ার গাড়ি। তখন থেকে তারা আবার অপেক্ষায় থাকেন তিস্তা নদী শুকিয়ে যাওয়ার।
উপজেলার তিস্তার চরে আলু চাষি রওশন আলি জানান, আমার ৬ একর জমিতে চাষ করা ১১শ বস্তা আলু এক মাত্র ঘোড়ার গাড়ি করে ঘাটে নিয়ে এসেছি। ঘোড়ার গাড়ি পরিবহন খরচ বস্তা প্রতি ৩০ টাকা করে দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, যাতায়াতের জন্য একটা ব্রিজ নির্মাণ করা হলে আমাদের পণ্য বহনে অনেক সাশ্রয় হতো।
উপজেলার তিস্তা পাড়ের পানিয়ালের ঘাটের মালিক সোহরাওয়ার্দী জানান, এখন তিস্তা নদীতে পানি অনেক কম। চর ভেসে উঠেছে যেখানে বালু আর বালু। এই চরাঞ্চলে কৃষি পণ্য বহন করার জন্য এক মাত্র উপায় ঘোড়ার গাড়ি। নদীতে পানি এসে যখন নদী জীবন ফিরে পায় তখন নৌকা দিয়ে পারাপার করা হয়। বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে কৃষি পণ্য ঘোড়ার গাড়িতে নিয়ে এপার থেকে ওপারে নিয়ে আসা যাওয়া করছেন। তিস্তায় পানি কমে যাওয়ায় সামান্য পানির উপর দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি মালামাল পার করছেন বলে জানান তিনি।
মন্তব্য করুন