

বাংলাদেশের অতি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ মিষ্টিগুলোর মধ্যে মেহেরপুরের সাবিত্রী এবং রসকদম্ব অন্যতম। এই মিষ্টি দুটির ইতিহাস ১৬৩ বছরের পুরোনো। ১৮৬১ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাসুদেব সাহার হাত ধরে। দেড় শতাব্দীর অধিক সময় পরও এই মিষ্টি দুটি ধরে রেখেছে একই স্বাদ ও গুণগতমান।
সাবিত্রী ও রসকদম্বের সুনাম এখন দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় সাবিত্রী মিষ্টিকে মেহেরপুর জেলার গর্ব বলে মনে করেন জেলাবাসী। প্রবাসীরাও এই মিষ্টি দিয়ে বিদেশিদের আকৃষ্ট করেন। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এই মিষ্টি দুটির জিআই সনদ প্রাপ্তির জন্য কাজ করা হবে বলে জানিয়েছেন।
ব্রিটিশ শাসন আমলে উৎপাদন শুরু হওয়া সাবিত্রী ও রসকদম্ব মিষ্টির স্বাদ এবং গুণগত মান এখনো একই রয়ে গেছে। বাসুদেব সাহার প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম টিকিয়ে রেখেছে তার উদ্ভাবন করা এ দুটি মিষ্টি।
সাবিত্রী দেখতে কিছুটা চমচমের মতো হলেও আকৃতিতে চ্যাপ্টা, এর রয়েছে ভিন্ন স্বাদ। এই মিষ্টির গায়ে খোদাই করে লেখা থাকে সাবিত্রী, যা দেশে অন্য কোনো মিষ্টির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। সাবিত্রীর স্বাদ কিছুটা নোনতা-মিষ্টি। এটাই সাবিত্রীর অনন্য বৈশিষ্ট্য। শুকনো মিষ্টি হলেও এর ভেতরটা রসালো এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রাতে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্বাদ অটুট থাকে।
আর রসকদম্ব নামের শুরুতে রস থাকলেও এটি মূলত একটি শুকনো মিষ্টি। তবে ভেতরের অংশটা অবশ্য কিছুটা রসালো। এর আকৃতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। রসকদম্বের উপরের অংশে সাগুদানার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা আবরণ মিষ্টির স্বাদকেও স্বতন্ত্র করেছে।
বাসুদেব সাহার দৌহিত্র বিকাশ সাহা কালবেলাকে জানান, বাজারে মিষ্টির কদর ও চাহিদা বাড়লেও গুণগত মান ধরে রাখতে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই মণের বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারে না তারা।
তিনি আরও জানান, সাবিত্রী ও রসকদম্ব তৈরির মূল উপাদানগুলোর সঙ্গে তারা কখনো আপস করেননি। ফলে এ দুটি মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। সেই ধারাবাহিকতাতে তারা ব্যবসা ধরে রেখেছেন।
গরুর দুধ আর দুধ জ্বালানোর জন্য তেঁতুল, নিম, বাবলা ও বেল জাতীয় ভারি কাঠের খড়ি ব্যবহার করা হয়। শুধু দুধ আর চিনি দিয়েই তৈরি হয়। খাঁটি মিষ্টি নিশ্চিত করতেই অন্য কোনো উপাদান ব্যবহার করা হয় না। প্রতিদিন সংগ্রহ করা দুধ ভারি কাঠ দিয়ে চুলায় জ্বালানো হয়। দিনের পুরো সময় দুধ জাল দেওয়া হয়। সন্ধ্যার দিকে জাল দেওয়া শেষ করে তা ঠান্ডা করার জন্য রেখে দেওয়া হয়। এই জাল দেওয়া দুধ থেকে পরদিন সকালে সাবিত্রী বানিয়ে বিক্রি করা হয়। বাপদাদার হাতের মিষ্টি তৈরির স্বত্ব তারা অন্য কাউকে দিতেও চান না। কারণ কেউ ভেজাল করলে দেড়শ বছরের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে।
মেহেরপুর জেলা জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর পল্লব ভট্টাচার্য কালবেলাকে বলেন, সাবিত্রী ও রসকদম্বকে মেহেরপুর জেলার গর্ব বলে মনে করা হয়। তবে সম্প্রতি একই নামে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জিআই পেতে আবেদন করেছে মালদহের রসকদম্ব। তাই এখন স্বীকৃতি লাভের জন্য দ্রুততার সঙ্গে মেহেরপুরের সাবিত্রী ও রসকদম্বর জন্য জিআই সনদ অর্জনের চেষ্টা করার সময় এসেছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, জমিদার আমল থেকেই এই মিষ্টির প্রচলন ছিল। মেহেরপুর শহরের বড়বাজারের বাসুদেব সাহার উদ্ভাবিত এই মিষ্টি ব্রিটিশ আমল থেকেই বাণিজ্যিকভাবে তৈরি ও বিক্রয় শুরু হয়। দ্রুতই জমিদারও ইংরেজদের কাছে এই মিষ্টি জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে কাল পরিক্রমায় সারা দেশে জনপ্রিয়তা অতিক্রম করে এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পরিচিত হয়ে ওঠেছে এই সাবিত্রী। প্রতি কেজি সাবিত্রী ও রসকদম্ব মিষ্টি স্থানীয় বাজারে এখন বিক্রি হয় ৫০০ টাকা কেজি দরে।
মন্তব্য করুন