‘যতদিন বাঁচব ততদিন শিখব’ এটা যে শুধু প্রবাদ বাক্য নয় সেটিই প্রমাণ করেছে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চরাইকোল গ্রামের হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণকারী প্রত্যেকেই কর্মজীবী, গৃহিণী ও বয়স্ক।
শিক্ষার কোনো বয়স নেই। প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষ সারা জীবনই কোনো না কোনোভাবে শিক্ষা অর্জন করে। শিক্ষা নীতিনৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধের মতো বিষয়কে অনুসমর্থন করে; যা সমাজের জন্য চিরকল্যাণকর।
স্থানীয়রা জানায়, এই বয়স্ক বিদ্যালয়ে নিরক্ষর কর্মজীবী মানুষের বাংলা, ইংরেজি, গণিতের পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাসহ কোরআন-হাদিস থেকে শেখানো হয়। শিক্ষার আলো থেকে ছিটকে পড়া সাক্ষরহীন মানুষগুলো এখানে সংসার সামলিয়ে পড়ালেখা শিখছেন। শিখছেন দস্তখতসহ প্রয়োজনীয় সব লেখা-ঝোকা। অঙ্কের গণনা থেকে শুরু করে বাংলা স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ, ইংরেজি এবিসির সঙ্গে সুরে সুরে উচ্চারণ করতে পারেন আরবি হরফও। সেইসঙ্গে দৈনন্দিন চলাফেরায় কী কী দোয়া-দরুদ প্রয়োজন, তাও আয়ত্ত করে ফেলেছেন বয়স্ক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
শমসের আলী (৫৫) পেশায় একজন ভ্যানচালক। বাল্যকালে অভাব অনটনে স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পারলেও মনে ছিল শেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। আর সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই ৫৫ বছর পর আজ তিনি হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের একজন বয়স্ক ছাত্র। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে সন্ধ্যার পর বিদ্যালয়ে আসেন। শুধু শমসের আলী নয় তার মতো আরও অনেক কর্মজীবী মানুষ সারাদিন বিভিন্ন কাজ শেষে বিদ্যালয়ে আসেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে।
বয়স্ক বিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রী রাবেয়া খাতুন বয়স ৮০ কোঠায়। তবুও শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে প্রতিনিয়ত আসেন হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ে। বয়সের ভারে ঠিকমতো চোখে না দেখলেও কম্পিত কণ্ঠে ক্লাসে শিক্ষিকার সাথে ব্ল্যাক বোর্ডের অক্ষরগুলো আয়ত্ত করার নিরন্তর চেষ্টা করেন তিনি।
তিনি বলেন, শেখার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল কিন্তু অভাব ছিল শেখানোর মানুষের। এই বিদ্যালয়ের কল্যাণে এখন আমি সাত মাসে অনেক কিছু শিখেছি।
আরেক শিক্ষার্থী জাহানারা বেগম (৬৫) জানান, গরিব ঘরে জন্ম নিয়েছিলাম লেখাপড়ার আগ্রহ থাকলেও টাকা পয়সার অভাবে শিখতে পারিনি। আজ এই বয়সে এসে অ্যাডভোকেট আকমল সাহেবের স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছে।
শিক্ষিকা নাইমা জান্নাত বলেন, তাদের এই বয়সে এসে শেখার তীব্র আগ্রহ দেখে আমি অবাক হই। কোনোদিন ভাবতে পারিনি এমন বয়স্ক মানুষদের শিক্ষা দেব। তারাও আমার পড়ানো বিষরগুলো মনোযোগ দিয়ে শেখার চেষ্টা করে। শিখেছে দস্তখতসহ প্রয়োজনীয় সব অনেক লেখা। এখন তারা ক্লাসের বই থেকে সবই পারে।
এই বিদ্যালয়ে পুরুষদের পাশাপাশি সমানভাবে শিখছে নারীরাও। পুরুষদের জন্য পুরুষ শিক্ষক এবং মহিলাদের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মহিলা শিক্ষক।
হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাওলানা মো. আব্দুল মালেক জানান, সমাজের নিরক্ষরতা দূরীকরণে অ্যাডভোকেট আকমল স্যারের এমন উদ্যোগ। তিনি বয়স্কদের কথা চিন্তা করে হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয় নির্মাণ করেছেন। বর্তমানে এখানে প্রায় ৩৫০ জন বয়স্ক ছাত্র-ছাত্রী নিয়মিত ক্লাস করে। কর্মজীবী, গৃহিণী এবং বয়স্করা যাতে তাদের সংসারের কাজ সামলে নিয়মিত ক্লাস করতে পারে সে জন্যই (সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা) তিন বেলায় ক্লাসের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট আকমল হোসেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘আকমল হোসেন শিক্ষা ও সেবা ফাউন্ডেশন’ এর আওতায় ৭টি শাখার মাধ্যমে প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক বয়স্ক পুরুষ ও নারীদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। এরই অংশ হিসেবে সমাজের কর্মজীবী বয়স্কদের নিরক্ষরতা দূরীকরণে এবং অবহেলিত মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নির্মাণ করেছেন হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়। তার এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ এরই মাঝে সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
বয়স্ক বিদ্যালয়ের পরিচালক অ্যাডভোকেট আকমল হোসেন বলেন, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের নিরক্ষরতা দূরীকরণে এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের দোরগোড়ায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতেই আমার এমন প্রচেষ্টা। হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ে শুধু বয়স্করাই নন অর্থাভাবে স্কুল বঞ্চিত ঝরে পরা শিশুরাও বিনা খরচে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির তরফ থেকে সুবিধা বঞ্চিত, অসহায়-পঙ্গু ও বিধবাদের মাঝে মাসিক ভাতাও প্রদান করা হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শুধু কুমারখালী নয় সমগ্র কুষ্টিয়াজুড়ে এ ধরনের শিক্ষার প্রসার ঘটবে বলে তিনি মনে করেন।
এ বিষয়ে কুমারখালী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কাজী এজাজ কায়সার বলেন, বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পে সরকারের আলাদা নজরদারি রয়েছে। একই সঙ্গে গ্রাম পর্যায়ে এমন শিক্ষার আলো যারা ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাদেরকেও সাধুবাদ জানান এই কর্মকর্তা। আমিই তাদের সাফল্য কামনা করি। আরও জায়গায় যেন এই বিদ্যালয় করতে পারে সে বিষয় কৃর্তপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।
কুমারখালী উপজেলার নবাগত নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম কালবেলাকে জানান, আমি উপজেলায় নতুন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছি, হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের বিষয়টা আপনাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। আমি ওই বয়স্ক বিদ্যালয় পরিদর্শন করবো, যদি ভালো কিছু দেখি অবশ্যই আমার কাছ থেকে তারা সর্বোচ্চ সাহায্য সহযোগিতা পাবে আশা করি।
মন্তব্য করুন