নারী মানে একজন মা, কন্যা, বোনসহ বিভিন্ন সম্পর্কের বন্ধন। এ সম্পর্কের মাঝে আছে অনেক মধুরতা, আবেগ, আনন্দ ও সুখের ছায়া। আবার এই নারীরাই অর্থনৈতিক মুক্তির তাগিদে প্রতিদিন ঘরে-বাইরে নিরলস সংগ্রাম করছেন স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য। আজ সাফল্যের পতাকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। এই এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে অনেক শ্রম-ত্যাগ-সাহসিকতার গল্প।
ফাতেমা বেগম একটি নাম একটি সংগ্রামী জীবনের আলোকিত গল্প, কখনো হারিয়ে না যাওয়া মায়ের জীবন্ত এক ছবি। ফাতেমা শত হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকা একজন অদম্য নারী, যিনি হতাশায় ডুবে না থেকে বারবার উঠে দাড়িয়েছেন এক নতুন উদ্যমে নিয়ে। ফাতেমা ভোরের সূর্যের মতো আলোকিত করেছেন অসহায় স্বামীর ডুবন্ত সংসার। ফাতেমা একাধারে একজন স্ত্রী, একজন মা। তিনি নিজে হাসতে জানেন না কিন্তু চার মেয়েকে হাসতে শিখিয়েছেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের পর্বতসম দুঃখ থাকা সত্ত্বেও নিজে কখনো দুঃখের জলে হারিয়ে যাননি। শত কষ্টের মাঝেও একজন যোদ্ধার মতো করে শুধু যুদ্ধ করে গেছেন। জীবনে কখনো সুখ খুঁজতে যাননি শুধু দুঃখগুলো সঙ্গী করে এগিয়ে গেছেন। ফাতেমা শুধুমাত্র তার সংসার ও তার মেয়েদের মাঝে সুখ খুজেছেন। ফাতেমা সুখ পাখিটা কখনো খুজে পেয়েছেন কিন্তু ছুতে পারেননি শুধু অপেক্ষায় আছেন সেই পাখির। যাকে তিনি একদিন ছুয়ে দেখবেন আর নিজের মতো করে লালন-পালন করবেন।
ফাতেমা বেগমের স্বামী খলিলুর রহমান ও চার মেয়েকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দক্ষিণ ইউনিয়নের হীরাপুর গ্রামে বসবাস করেন। যে গ্রামটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত লাগোয়া একটি গ্রাম। অসুস্থ স্বামী খলিলুর রহমান পেশায় একজন রিকশা চালক। অভাবের সংসার তাই কখনো নিজের টাকায় একটি রিকশার মালিক হতে পারেনি। মানুষের রিকশা ভাড়ায় চালান, মালিকের টাকা দিয়ে বাকি যা থাকে তাই নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তার ওপর নিজের অসুস্থতার জন্য নিয়মিত রিকশাও চালাতে পারেন না। অসুস্থ খলিলুর রহমানকে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। অভাবের সংসার তার ওপর এই ওষুধ যেন এক আতংকের নাম।
ফাতেমা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শশুড়ের রেখে যাওয়া সামান্য জায়গাতে দোচালা একটি মাটির ঘর যা ফাতেমার একমাত্র সম্বল। অসুস্থ স্বামীর সংসারে অভাব অনটনের কথা চিন্তা করে তিনি একটি সেলাই মেশিন কিনে প্রতিবেশিদের কাপড়-চোপড় সেলাই করেন। ঈদের সময় যখন কাজ বেশি থাকে তখন সারাদিন সংসারের কাজ সেড়ে রাত জেগে কাপড় সেলাই করেন। পাশাপাশি হাসঁ-মুরগি পালন করেন আবার কখনো অন্যের জায়গায় সবজি চাষ করেন। এত পরিশ্রম করেও ফাতেমা কখনো সংসার, সন্তানদের প্রতি বিরক্ত হননি। ফাতেমাকে ক্লান্তি কখনো দমিয়ে রাখতে পারেনি। এভাবেই চলছে ফাতেমার পথ চলা, কখন গন্তব্যে পৌঁছাবে তা তিনি নিজে কখনো বলতে পারেনি। তবে এটুকু ফাতেমা জানে যে তাকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তিনি পথ যদি দুর্গম পাহাড় কিংবা বিশাল জলরাশির এক নদী কিংবা অন্ধকারাচ্ছন্ন কোন পথ সে যাই হোক। ফাতেমা ক্লান্ত হয়ে চলতে জানে কিন্তু ক্লান্ত হয়ে বসে থাকতে জানেনা।
আরও দেখা যায়, ফাতেমা বেগম ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাবার দৈন্নতার সংসারে খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি। নিজের প্রচেষ্টায় কোন রকমে এসএসসি পর্যন্ত গিয়ে থেমে যেতে হয়েছিল। তাই তিনি তার মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যপারে খুবই সচেতন। তার ৪ মেয়ে। অভাবের সংসারেও মেয়েদের পড়ালেখা চালিয়ে যান। সন্তানদের নিয়ে ফাতেমা স্বপ্ন দেখে একদিন তার মেয়েরা লেখাপড়া করে চাকরি করবে। নিজেদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে। আর সেই স্বপ্নই ফাতেমার মাঝে এক নতুন আশার প্রদীপ জ্বালায়।
ফাতেমার চার মেয়ে, বড় মেয়ে সাবিনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাষ্টার্স শেষ করে কিছুদিন নিজের বিদ্যাপীঠ হীরাপুর শহীদ নোয়াব মেমোরিয়্যাল উচ্চ বিদ্যালয়ে চুক্তি ভিত্তিক শিক্ষকতা করছেন। বর্তমানে একটি এজেন্ট ব্যাংকে কর্মরত। দ্বিতীয় মেয়ে মাহমুদা চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অর্নাস কলেজ থেকে অনার্স শেষ করে বর্তমানে একটি ইউনিয়ন পরিষদের সহকারী সচিব পদে কর্মরত। তৃতীয় মেয়ে ফারজানা চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত এবং চতুর্থ মেয়ে সানজিদা হীরাপুর শহীদ নোয়াব মেমোরিয়্যাল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন।
অদম্য এ নারী গত ২০২১ সালে সফল জননীর স্বীকৃতিস্বরূপ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর থেকে জয়িতা নির্বাচিত হন।
হীরাপুর শহীদ নোয়াব মেমোরিয়্যাল উচ্চ বিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, ফাতেমার চার মেয়েই আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থী। তারা ছাত্রী হিসেবে খুবই মেধাবী ও পরিশ্রমি। তারা ক্লাসে সবসময় মনযোগী ছিল ও স্কুলের বার্ষিক পরিক্ষাগুলোতে তাদের স্থান সবসময় সেরাদের মধ্যে ছিল। সর্বোপরি তারা আমাদের স্কুলের গর্ব।
ফাতেমা বেগমের বিষয়ে আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মো. আয়েত আলী বলেন, ফাতেমা বেগম অবিরাম জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক নারী তিনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে প্রতিনিয়ত বেঁচে আছেন। ফাতেমা বেগম অনেক কষ্ট করে সংসার সামলে মেয়েদেরকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। মেয়েরা কষ্ট করে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ফাতেমা বেগম একজন সফল নারী, সফল মা। নারীদের জন্য তিনি একজন অনুপ্রেরণা।
মন্তব্য করুন