পড়ালেখার পাশাপাশি বেশ ভালো ক্রিকেট খেলতেন ইমরান খান মুকুল। একসময় জেলা পর্যায়ের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, রংপুর প্রিমিয়ার লিগসহ আন্তঃস্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলেছেন তিনি। স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে একদিন দেশের হয়ে খেলবেন। কিন্তু পিতার সংসারের অভাব অনটন, মাঝখানে করোনার কারণে ছন্দপতন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ক্রিকেট নিয়ে বেশিদূর এগোতে পারেননি তিনি।
তবে নিজের স্বপ্ন পূরণ না হলেও এলাকার কিশোর-তরুণদের জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন এই তরুণ। এ জন্য নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি ক্রিকেট একাডেমি। যে একাডেমির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ ক্রিকেটার তৈরি করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। স্বপ্ন দেখছেন তার হাতে গড়া ক্রিকেটারদের মধ্যে কেউ না কেউ একদিন জাতীয় দলে খেলবেন। আর সেদিনই তার অতৃপ্ত বাসনা পূরণ হবে।
ইমরান খান মুকুলের বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার দেউতি গ্রামে। আব্দুল হামিদ ও বুলবুলি বেগমের ২ মেয়ে ও ২ ছেলের মধ্যে সবার ছোট মুকুল। এইচএসসি পাস করার পর অনার্সে ভর্তি হলেও অভাবের কারণে তা আর সম্পন্ন করা হয়নি। জীবিকার তাগিদে বর্তমানে দেউতি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট পদে চাকরি করছেন তিনি।
২০২২ সালে তার হাতে গড়া একটি ক্রিকেট টিম জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। সেখান থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে নিজ খরচে ‘দেউতি ক্রিকেট একাডেমি’ নামে একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে পরিপূর্ণ একাডেমি বলতে যা বোঝায় সে রকম কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও নিজের যতটুকু আছে তা দিয়েই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
আপাতত দেউতি পুরোনো মাঠের পাশে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এ যাবৎ তার একাডেমি থেকে প্রায় শতাধিক কিশোর-তরুণকে তিনি বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি ২০ জনের একটি ব্যাচকে কোচিং করাচ্ছেন। চাকরি করে যে বেতন পান সেখান থেকেই একটি অংশ তিনি এর পেছনে ব্যয় করছেন।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বিকেলে পীরগাছা উপজেলার দেউতি পুরোনো মাঠে গিয়ে দেখা যায়, উঠতি বয়সের ১৫-২০ জন কিশোর-তরুণকে অনুশীলন করাচ্ছেন প্রশিক্ষক ইমরান খান মুকুল।
এ সময় শাহরিয়ার মাহমুদ সজীব নামে এক প্রশিক্ষণার্থী বলেন, বিশ্বের নামিদামি ক্রিকেটাররা দেখতাম কত সুন্দর ক্রিকেট খেলে। আমি ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতাম তাদের মতো ক্রিকেটার হওয়ার। দেশের জন্য কিছু করার। আমি আমার কোচ মুকুল স্যারের কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি।
প্রশিক্ষণার্থী রাকিবুল ইসলাম বলেন, আমাদের একাডেমিতে বল-ব্যাটের সংকট রয়েছে। ভালো কোনো নেট নেই, পিচের অবস্থাও তেমন ভালো না। জার্সি নেই। টাকার অভাবে আমরা দূরে কোথাও খেলতে যেতে পারি না। মুকুল ভাই আমাদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আমাদের কোনো কিছু দরকার হলে মুকুল ভাই কিনে দেন। আমরা যদি ভালো সহযোগিতা পেতাম তাহলে হয়তো আমরা একদিন জাতীয় দলে সুযোগ পেতাম।
সাদিক হাসান মনিরুল নামে আরও এক প্রশিক্ষণার্থী বলেন, আমি এই একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনূর্ধ্ব-১৪ খেলেছি। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশের জাতীয় দলে খেলব। আমাদের একাডেমিতে প্র্যাক্টিস করার জন্য যে সুযোগ সুবিধা থাকা দরকার তা অপ্রতুল। আমাদেরকে যদি সহযোগিতা করা হয় তাহলে আমরা একদিন বিশ্বের বুকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারব।
ইমরান খান মুকুল বলেন, আমি অভাব অনটনের কারণে নিজেকে ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। জাতীয় দলে খেলার ইচ্ছা ছিল। পূরণ করতে পারিনি। এখন গ্রামের এই ছেলেদের নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখছি। তাদেরকে মাদক ও মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে রাখতে খেলামুখী করার চেষ্টা করছি। আমার বিশ্বাস আমার এই একাডেমি থেকে কেউ না কেউ একদিন জাতীয় দলে খেলবে। আর সেদিনই আমার স্বপ্ন পূরণ হবে। আমি সকলের কাছে দোওয়া ও সহযোগিতা চাই।
দেউতি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এবিএম মিজানুর রহমান সাজু বলেন, আমার কলেজের চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারী মুকুল নিজ উদ্যোগে ক্রিকেট একাডেমি গড়ে তুলেছেন। নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসনীয়। আমি ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি তারা জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশগ্রহণ করেছে এবং ভালো করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ও ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে তাদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করব।
মন্তব্য করুন