দুর্নীতির মামলায় বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আমান উল্লাহ আমানের ১৩ বছর এবং তার স্ত্রী সাবেরা আমানের তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়ে ঘোষিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। রায় প্রদানকারী দুই বিচারপতির স্বাক্ষরের পর আজ সোমবার (৭ আগস্ট) তা সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। রায়ের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে পৌঁছানোর ১৫ দিনের মধ্যে আমান দম্পতিকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে এই রায়ে।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৮১ পৃষ্ঠার এই রায়ে আজ স্বাক্ষর করেন। এর আগে গত ৩০ মে হাইকোর্টের একই বেঞ্চ এ মামলায় আমান দম্পতির কারাদণ্ড বহাল রেখে আদেশ দেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, রাজনীতিবিদরা জনগণ ও দেশের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করার লক্ষ্যে রাজনীতিতে জড়িত হন এবং রাজনীতি জনগণ ও দেশের কল্যাণে এক ধরনের মহান ত্যাগ-নিষ্ঠার কাজ। তাই রাজনীতিবিদরা জনগণের সম্পদের রক্ষক হবেন, তারা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না।
আদালত বলেন, বৈধ ব্যবসা এবং অন্যান্য পেশার আশ্রয় নিয়ে অর্থ-সম্পত্তি অর্জনের অনেক উপায় রয়েছে। তবে অর্থ উপার্জনের জন্য রাজনীতি কোনো পেশার আওতায় আসতে পারে না। এই আদালতের পবিত্র ইচ্ছে এই, যারা রাজনীতিতে জড়িত তারা যেন টাকা-পয়সা ও সম্পত্তির পেছনে না ছোটেন। রাজনীতিবিদরা যদি বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি এবং অর্থের অধিকারী হন, তবে তাদের সম্পদ টিকিয়ে রাখার পেছনে জীবনের অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। সেক্ষেত্রে জনগণ ও দেশের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য তাদের খুবই কম সময় থাকে।
আরও পড়ুন : ঢাকা-১৭ আসনের মতো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না : আমান
আদালত বলেন, দুর্নীতি সমস্ত লিঙ্গ, বয়স এবং বর্ণের মানুষকে প্রভাবিত করে। এটি দরিদ্র ও দুর্বল গোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করে। দেশের জনগণ বিশেষ করে দায়িত্বশীল স্টেকহোল্ডারদের একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত, যে তারা কেবল দুর্নীতির শিকারই নয়, বরং তারা এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূল খেলোয়াড়ও।
পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট আরও বলেন, দুর্নীতিবাজরা তাদের সমালোচকদের চুপ করতে এবং চুরি করা সম্পদ লুকানোর জন্য একে-অপরকে সাহায্য করে। তাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করার সময় এসেছে।
আদালত বলেন, বিশ্ব ও বাংলাদেশের পরিবর্তনের অপেক্ষায় নাগরিকরা বসে থাকতে পারে না, আমাদের প্রত্যেককে সেই পরিবর্তনের অংশ হতে হবে। বাংলাদেশিদের জন্য বাংলাদেশি ছাড়া কেউ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে না। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাইকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।
দুর্নীতির অবসান ঘটানো লক্ষ্য হওয়া উচিত উল্লেখ করে আদালত বলেন, একটি বৈশ্বিক আন্দোলন হিসেবে আমাদের লক্ষ্য হলো বিশ্বে এবং বাংলাদেশে দুর্নীতির অবসান ঘটানো, তা যেখানেই হোক বা যে রূপেই হোক না কেন। আমরা জানি যে সফল হওয়ার একমাত্র উপায় হলো নাগরিকদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সম্পৃক্ত করা। আমরা সমাজ থেকে সব ধরনের দুর্নীতি এবং অর্থপাচারের উপশম প্রতিরোধ এবং মূলোৎপাটন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আমান দম্পতির আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আমান উল্লাহ আমান সম্পদের কোনো তথ্যই গোপন করেননি। যেসব সম্পদের বিবরণ দুদকে দেওয়া হয়েছে, সেসব সম্পদের কর দেওয়া হয়েছে। ফলে আমরা আশা করছিলাম আমান উল্লাহ আমান খালাস পাবেন। কারণ এই আদালতেই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে খালাস দেওয়া হয়েছিল। এই মামলার শুনানিতে মায়ার মামলার উদাহরণ, নজির দেখিয়েছি। কিন্তু আদালত বিচারিক আদালতের সাজাই বহাল রেখেছেন।
তিনি আরও বলেন, এ রায়ে আমান উল্লাহ আমান ও তার স্ত্রী ন্যায়বিচার না পাওয়ায় সংক্ষুব্ধ। তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। আর রায়ের অনুলিপি পেলে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাওয়া হবে।
সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আমান দম্পতির বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ৬ মার্চ রাজধানীর কাফরুল থানায় মামলা করে দুদক। ওই বছরের ২১ জুন বিশেষ জজ আদালতের রায়ে আমানকে ১৩ বছরের ও সাবেরাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট সেই আপিল মঞ্জুর করে তাদের খালাস দেন। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করলে ২০১৪ সালে আপিল বিভাগ সে রায় বাতিল করে হাইকোর্টকে আপিল মামলাটি পুনঃশুনানির নির্দেশ দেন। আপিলের পুনঃশুনানি শেষে গত ৩০ মে সাজা বহাল রেখে রায় দেন হাইকোর্ট।
মন্তব্য করুন