টানা বৃষ্টিতে দেশের একদিকে যেমন ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে, আবার অন্যপ্রান্তে বৃষ্টির অভাবে ফসল ফলাতে কষ্ট হচ্ছে কৃষকের। আবহাওয়ার এমন বৈপরীত্যে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি নোয়াখালী, ফেনীসহ ২০ জেলায় বন্যা হয়েছে। বন্যায় ৪২৯ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পর পানি নেমে গেলেও এসব জেলাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বর্তমানে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে কৃষকের ফসলের মাঠ, বীজতলা, সবজিক্ষেত সবই পানিতে ডুবে আছে। মৌসুমি বায়ু, নিম্নচাপ ও অতিবৃষ্টিতে পানি বৃদ্ধির কারণে আক্রান্ত ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত জেলার মধ্যে রয়েছে কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, পাবনা, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা ও শরীয়তপুর।
অতিবৃষ্টিতে এসব জেলার ক্ষেতের ফসল, আমন বীজতলা, পুকুর ও খামারের মাছ, পোলট্রি খামার, হাঁস-মুরগি, রাস্তা ও বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সম্প্রতি ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার মুহুরী নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় উপজেলা দুটির পশ্চিম অলকা, ঘোয়াল গ্রাম, পশ্চিম অলকা, ধনিকুন্ডা, নয়াপুর, জঙ্গল ঘোনা, শালধর, মধুগ্রাম, উত্তর শ্রীপুর, দেড়পাড়া, নিলখী, দৌলতপুর গ্রাম প্লাবিত হয়। বন্যার পানিতে ভেঙে যায় রাস্তাঘাট ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮ হাজার হেক্টর আউশ-আমন ধানসহ নানারকম শাকসবজি। এ ছাড়া ভেসে গেছে প্রায় ১৩ হাজার মৎস্য খামারের মাছ।
ফেনী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় জেলায় আউশ ৮৪৫ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৫৩৭, মরিচ ১৪, আদা ৭, হলুদ ২ দশমিক ৫, টমেটো শূন্য দশমিক ১১, আমন বীজতলা ৬৮৯ এবং বস্তায় সংরক্ষিত আদা ৩ হাজার ৪৭০ হেক্টরসহ মোট ৫ হাজার ৫৬৪ দশমিক ৬১ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ২৮ হাজার ৮৩৫ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ কোটি ৭ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্যাদুর্গত এসব এলাকায় এবারও কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি ছাড়িয়েছে ২৪৬ কোটি টাকা।
নোয়াখালী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, ৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলার ছয়টি উপজেলার ৫৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ২ লাখ ৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। এ ছাড়া সেনবাগ, কবিরহাট ও সুবর্ণচর উপজেলায় আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৭টি বসতঘর এবং সুবর্ণচরে একটি ঘর সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়েছে। কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট, সদর, সেনবাগ, সুবর্ণচর ও হাতিয়া উপজেলার নিম্নাঞ্চলে এখনো পানি রয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা রয়েছে কবিরহাট, সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও সেনবাগে।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যেমন বন্যার পর অতিবৃষ্টি, ঠিক তার বিপরীত চিত্র উত্তরাঞ্চলে। সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে ভরা মৌসুমেও তেমন দেখা নেই বৃষ্টির। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। শুধু তাই নয়, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ উত্তরের অনেক জেলায় একই চিত্র। অনাবৃষ্টির তীব্র তাপের কারণে রোপা আমনের চাষাবাদে বিপাকে চাষিরা। অন্যান্য বছর এই সময় ধানের চারা রোপণ শেষ হলেও অনাবৃষ্টির কারণে এ বছর শুরুই করতে পারেননি অনেক কৃষক। বিশেষ করে পাটচাষিরা রয়েছেন চরম বিপাকে। পানির অভাবে পাট ভেজাতে পারছেন না তারা।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, পর্যাপ্ত পানির অভাবে এ জেলায় কৃষকরা পাট জাগানো নিয়ে সমস্যায় রয়েছেন। তবে পানি না থাকায় আমরা ‘রিবন রেটিং’ পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছি। যাদের মেশিন নেই তারাও কাঁচা পাট থেকে ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে ছোট গর্তের মধ্যে অল্প পানিতেই পাট জাগ দিতে পারেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. মো. জামাল উদ্দীন কালবেলাকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আবহাওয়ার চরম বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। একদিকে বন্যা, অতিবৃষ্টি এবং অন্যদিকে খরা, অনাবৃষ্টি। একদিকে বৃষ্টিতে ফসলের মাঠ ও বীজতলা তলিয়ে যাচ্ছে এবং অন্যদিকে পর্যাপ্ত পানির অভাবে ফসল বপন করতে পারছেন না কৃষক। এতে কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। তিনি জানান, নোয়াখালী অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় প্রায় আড়াই লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমনের বীজতলা তৈরি, বসতবাড়িতে সবজির বাগান, আগাম শীতকালীন সবজি চাষের ব্যবস্থা করার জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে এসব ঘটনা মোকাবিলার জন্য ৭ কোটি টাকার প্রণোদনা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
অতিরিক্ত পরিচালক (সম্প্রসারণ ও কো-অর্ডিনেশন) ড. মো. আব্দুল আজিজ কালবেলাকে বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তিনটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে প্রণোদনার জন্য। আমনের বীজতলা তৈরি, বসতবাড়িতে সবজির বাগান করা, আগাম শীতকালীন সবজি চাষের ব্যবস্থা করা। এই তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
মন্তব্য করুন