ফ্যাটি লিভার নামটা শুনতে সাধারণ লাগলেও এটি এক ধরনের লাইফস্টাইল ডিজিজ। অর্থাৎ আমাদের খাওয়া-দাওয়া ও দৈনন্দিন অভ্যাসের ভুলের ফলেই এই রোগ ধীরে ধীরে শরীরে বাসা বাঁধে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের শিশু-কিশোর-কিশোরী খাদ্য ও পুষ্টিবিদ স্বরমিতা হালদার বলছেন, ‘সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নিলে ফ্যাটি লিভার থেকে সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারের মতো জটিল সমস্যাও হতে পারে।’
চলুন পুষ্টিবিদ স্বরমিতা হালদার মতে জেনে নিই, কী এই ফ্যাটি লিভার, কেন হয়, কীভাবে বুঝবেন এবং কীভাবে বাঁচবেন।
ফ্যাটি লিভার হচ্ছে এমন এক অবস্থা, যেখানে লিভারে স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত চর্বি জমে যায়। এটা ধীরে ধীরে লিভারের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
আরও পড়ুন : কিডনি ভালো না থাকলে শরীর যেভাবে সিগন্যাল দেয়
আরও পড়ুন : চোখের নীরব বিপদ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি
যখন লিভারের ৫% বা তার বেশি ফ্যাট জমে, তখন থেকেই ফ্যাটি লিভার শুরু হয়। এটি ৩টি ধাপে বিভক্ত:
গ্রেড ১: লিভারে ৫–১০% চর্বি জমে
গ্রেড ২: ১০–২৫% চর্বি
গ্রেড ৩: ৩০% বা তার বেশি চর্বি জমে— এটি সবচেয়ে ভয়ানক পর্যায়
১. অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ
২. নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD) — বর্তমানে এটি অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে, এমনকি অ্যালকোহল না খেলেও।
বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ৪ জনে ১ জন মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন। বাংলাদেশেও আক্রান্তের হার বাড়ছে।
প্রথম দিকে অনেকেই বুঝতেই পারেন না, কারণ অনেক সময় কোনো লক্ষণই থাকে না। তবে কিছু সাধারণ উপসর্গ হতে পারে:
- পেটের ডান পাশে হালকা ব্যথা বা ভারী ভাব
- পেট ফোলা ফোলা লাগে
- শরীরে ক্লান্তি, দুর্বলতা
- খিদে না পাওয়া, ওজন কমে যাওয়া
- মাঝে মাঝে বমি ভাব
প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগের নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। জীবনধারার পরিবর্তনই একমাত্র উপায়।
কী করতে হবে
- প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪০ মিনিট শরীরচর্চা করুন (যাতে ঘাম ঝরে)
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
- ধূমপান ও অ্যালকোহল একেবারে বাদ দিন
- খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন
যা যা খাবেন
লেবু মধুর গরম পানি সকালে
সবুজ শাকসবজি: পালং, কচু শাক ইত্যাদি — এগুলো লিভারকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে
করলা, বিট, ব্রকলি, বাদাম, আখরোট — ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর
রসুন — লিভারের এনজাইম সক্রিয় করে
কফি — লিভারের ক্ষতি কমায়
মটরশুঁটি, সয়া, ডাল — পেট পরিষ্কার রাখে
চর্বিযুক্ত মাছ: পমফ্রেট, স্যামন, রুই-কাতলা — ওমেগা-৩ চর্বি লিভারের চর্বি কমায়
ফল: পেপে, টক ফল (আমলকি, জাম্বুরা), সবুজ আপেল, আনারস, পেয়ারা
যেসব খাবার এড়িয়ে চলবেন
- সাদা ভাত, রুটি, পাস্তা (রিফাইন্ড কার্বস)
- চিনি ও চিনিযুক্ত পানীয়
- গরু/খাসির মাংস
- অতিরিক্ত তেল, ভাজাপোড়া
- ক্যান্ডি, বেকারি পণ্য, প্যাকেটজাত খাবার, ফাস্টফুড
- অ্যালকোহল
সীমিতভাবে খেতে হবে যেসব ফল
পাকা আম, মিষ্টি আঙুর, কলা, খেজুর — এতে ফ্রুক্টোজ ও ক্যালোরি বেশি, লিভারে চর্বি বাড়ায়
প্রথম দিন
সকাল: সেদ্ধ ডিমের সাদা অংশ + বাদাম রুটি + লেবুপানি
দুপুর: ½ কাপ ভাত + ডাল + শাক + রুই মাছ
আরও পড়ুন : নিয়মিত বেদানা খাওয়ার ৭ দারুণ উপকারিতা জানালেন পুষ্টিবিদ
আরও পড়ুন : কোলেস্টেরল কমাতে পুষ্টিবিদের সহজ পরামর্শ
বিকেল: পেয়ারা / সবুজ আপেল + গ্রিন টি
রাত: সবজি খিচুড়ি + মুরগির বুকের মাংস
দ্বিতীয় দিন
সকাল: ওটস/চিড়া + ২টা বাদাম
দুপুর: করলা ভাজি, বিট সালাদ, ডাল, মুরগি + অল্প ভাত
বিকেল: আমলকি / জাম্বুরা + কফি
রাত: ২টা রুটি + সবজি
তৃতীয় দিন
সকাল: লেবুপানি + ৪টা বাদাম + অর্ধেক কলা
দুপুর: পালং শাক, মসুর ডাল, সেদ্ধ মাছ + অল্প ভাত
বিকেল: আনারস + গ্রিন টি
রাত: সবজি স্যুপ + ডিমের অমলেট (তেল ছাড়া)
চতুর্থ দিন
সকাল: ওটস/খিচুড়ি + গ্রিন টি
দুপুর: ভাত + ঢেঁড়স / ঝিঙা + রুই মাছ
বিকেল: পেঁপে / পেয়ারা
রাত: ২টা রুটি + সেদ্ধ মুরগি
পঞ্চম দিন
সকাল: টোস্ট + ডিমের সাদা অংশ + লেবুপানি
দুপুর: করলা ভাজি, ডাল, লইট্টা মাছ + অল্প ভাত
বিকেল: আমলকি + কফি
রাত: মিক্সড ভেজিটেবল খিচুড়ি + টেংরা মাছ
ষষ্ঠ দিন
সকাল: চিড়া + দই + বাদাম
দুপুর: ফুলকপি / বাঁধাকপি + ডাল + কাতলা মাছ
বিকেল: আপেল + গ্রিন টি
রাত: সবজি স্যুপ + ডিমের অমলেট
সপ্তম দিন
সকাল: ওটস/ডালিয়া + বাদাম + লেবুপানি
দুপুর: পালং শাক + ডাল + পুঁটি মাছ + ভাত
বিকেল: পেঁপে / আনারস + কফি
রাত: ২টা রুটি + ডাল + গ্রিল মুরগি / সেদ্ধ মাছ
- প্রতিদিন ৮–১০ গ্লাস পানি পান করুন
- রাতে ঘুমানোর অন্তত ২ ঘণ্টা আগে খাবার শেষ করুন
- ওজন ধীরে ধীরে কমান, হঠাৎ নয়
- ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমান
- মানসিক চাপ কমান
- যদি ফ্যাটি লিভার গ্রেড ২ বা ৩ হয়, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আরও পড়ুন : হঠাৎ শরীর ফুলে যাচ্ছে? হতে পারে ভেতরে লুকানো বড় কোনো সমস্যা
আরও পড়ুন : গ্যাসের সমস্যায় স্বস্তির কিছু ঘরোয়া উপায়
মনে রাখবেন, লিভার বাঁচাতে হলে, ওজন ঠিক রাখতে হবে, খাবারে সংযম রাখতে হবে, আর নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে!
মন্তব্য করুন