আবেগ হলো একটি জটিল প্রতিক্রিয়া পদ্ধতি, যা অভিজ্ঞতা, আচরণ ও শারীরিক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা আমাদের পছন্দ-অপছন্দ এই আবেগের মাধ্যমে জানতে ও বুঝতে পারি এবং অনুভূতির সাহায্যে তা ব্যাখ্যা করে থাকি। প্রত্যেক মানুষের আবেগের ধরন এক। যেমন: রাগ, দুঃখ, আনন্দ, ভয়, বিরক্তি, বিস্ময়। মস্তিষ্কে রাসায়নিক নিঃসরণের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে এ ধরনের আবেগের উদ্ভব হয়।
যার মাধ্যমে একজন মানুষ তার আবেগকে চিনতে, বুঝতে ও ইতিবাচক উপায়ে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়, সেই সামর্থ্যকে বলে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি যেমন ব্যক্তিভেদে আলাদা, তেমনি ব্যক্তির নিজস্ব আবেগীয় শৃঙ্খলার ধরনও আলাদা হয়ে থাকে। দৈনন্দিন জীবনে এই শৃঙ্খলা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ তাই নিজের আবেগীয় শৃঙ্খলার দিকে খেয়াল রাখেন বা সচেতন থাকেন। তবে মানসিক স্বাস্থ্যের উপাদান হিসেবে চিহ্নিত সাধারণ মনোদৈহিক বিষয়, যেমন- চিন্তা-ভাবনা, শারীরবৃত্তীয় বিষয়, যা আবেগের উপাদান হিসেবে আবেগকে পরিচালিত করে, এসব উপাদানের ব্যবস্থাপনা বা ম্যানেজমেন্টের গবেষণালব্ধ উপায় রয়েছে। মূলত আবেগ-অনুভূতিও মানসিক স্বাস্থ্যের মূল উপাদান। ব্যক্তির ভালো থাকার পর্যায় এসব উপাদানের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে।
জেনে নিন উদ্বেগ কমানোর ৫ উপায়
আবেগীয় শৃঙ্খলার মধ্যে আছে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ভবিষ্যতে প্রতিকূলতা মোকাবেলার সক্ষমতা, ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণের সংগ্রহশালা থেকে সময়োচিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণের মাধ্যমে আবেগের উপযুক্ত ব্যবহার করে নিজের ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। এক্ষেত্রে জরুরি কয়েকটি ধাপ হলো- উপযুক্ত কৌশল নির্বাচন, নির্ধারণ ও নিয়মমাফিক অনুশীলন। আবেগ ব্যবস্থাপনা, অনুভূতির ইতিবাচক প্রকাশ ও আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের মাধ্যমে আবেগীয় শৃঙ্খলা বা ইমোশনাল ডিসিপ্লিনের কার্যকর চর্চা করা আবশ্যক।
আবেগীয় শৃঙ্খলা মেনে চলার প্রথম ধাপ হলো- ব্যক্তির নিজস্ব আবেগ অনুভূতির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার আবেগীয় অবস্থা কেমন, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজেকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় আনতে কী কী কৌশল কাজ করবে, তার অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে। নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় আবেগীয় শৃঙ্খলার ভিত্তি আরও মজবুত করতে হবে।
লিডারশিপ এক্সপার্ট চার্লস ম্যানয (Charles C. Manz) মনে করেন, আমরা কী অনুভব করব, তা পছন্দ করার সামর্থ্য থাকাই হলো আবেগীয় শৃঙ্খলা। ইমোশনাল ডিসিপ্লিন বইতে তিনি পাঁচটি ধাপের কথা বলেছেন। এসব ধাপের অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তি তার বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবেগীয় দক্ষতার উপযুক্ত ব্যবহারে সাফল্য অর্জন করে থাকে। ধাপগুলো হলো-
১। আবেগের তাৎক্ষণিক চিহ্ন বা সংকেতগুলোর ব্যাপারে অবগত থাকা; ২। শরীরের কোন জায়গায় প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, তা বোঝা এবং তীব্রতা যাচাই করা; ৩। চিন্তা ও অনুভূতিগুলো খেয়াল করা, যা আপনার শারীরিক প্রতিক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট; ৪। খেয়াল করা, আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার সময় কোন অংশটি সামনে আসে (ভয়ানক ইগো, না-কি সুস্থ মন), আত্মিক কোন পর্যায়টি সামনে আসেনি। ৫। প্রত্যক্ষ ও আকস্মিক প্রতিকূলতায় একটি আবেগীয় শৃঙ্খলা পদ্ধতির নির্বাচন এবং এর সফল বাস্তবায়ন।
আবেগীয় শৃঙ্খলা অনুশীলনের শুরুর দিকে আপনি ধাপগুলো লিখে রাখতে পারেন। তাহলে আপনার আবেগ কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা খেয়াল করতে পারবেন। আবেগীয় শৃঙ্খলা অনুশীলনের জন্য আরও কিছু কৌশল যোগ করতে পারেন। সেগুলো হলো-
মেন্টাল রিফ্রেমিং: পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করা। কঠিন সময়ে ঝুঁকির সাথে সাথে কী কী সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তা বিবেচনা করা।
রিলাক্সেশন: প্রগ্রেসিভ মাসল রিলাক্সেশন, সংক্ষেপে পিএমআর আবেগ ব্যবস্থাপনার খুবই কার্যকর পদ্ধতি।
গ্রাউন্ডিং টেকনিক: নিজের চারপাশ থেকে তিনটি জিনিস দেখা ও নামকরণ করা বা নাম বলা, তিন ধরনের শব্দ শোনা এবং শরীরের তিনটি অঙ্গ নাড়াচাড়া করা। যেমন- পায়ের আঙ্গুল, হাতের আঙ্গুল নাড়ানো বা হাত মুষ্টিবদ্ধ করা ও খোলা এবং ঘাড় কান পর্যন্ত তুলে কিছুক্ষণ ধরে রেখে আস্তে আস্তে ছেড়ে দেওয়া।
শরীরের যত্ন: নিজের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম ও পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা রাখা।
সর্বোপরি, একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে কাজ করে আপনার ব্যক্তিগত আবেগীয় শৃঙ্খলা বা ইমোশনাল ডিসিপ্লিন প্রোফাইল তৈরি করে নিতে পারেন। যা পরবর্তীতে আবেগীয় সমস্যা মোকাবেলায় এবং নতুন পরিস্থিতিতে ভারসাম্যপূর্ণ আবেগ প্রকাশে আপনাকে সহায়তা করবে।
লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, লাইফস্প্রিং লিমিটেড
ই-মেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন