হয়তো আপনি আজই তোয়ালে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কী, যে তোয়ালেতে নিজেকে মুছলেন সেটি আসলেই কতটা পরিষ্কার ছিল? অনেকেই সপ্তাহে একবার তোয়ালে ধুয়ে নেন, কেউ আবার মাসে একবার। এমনকি যুক্তরাজ্যের এক জরিপে দেখা গেছে, কিছু মানুষ বছরে মাত্র একবার তোয়ালে ধৌত করেন!
বাহ্যিকভাবে তোয়ালে যতই পরিষ্কার দেখাক না কেন, বাস্তবে এটি লাখ লাখ জীবাণুর প্রজননক্ষেত্র। গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের ত্বকের ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি অন্ত্রের জীবাণুও সহজেই তোয়ালের আঁশে জমে থাকে।
কীভাবে তোয়ালে দূষিত হয়
গবেষকরা বলছেন, গোসলের পরও শরীরে অজস্র জীবাণু থেকে যায়। তাই তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছলে সেই জীবাণুগুলোর কিছু তোয়ালেতে স্থানান্তরিত হয়। এরপর শুকানোর সময় বাতাসে ভেসে বেড়ানো ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসও তাতে বসে যায়। এমনকি যে পানিতে তোয়ালে ধোয়া হয়, সেখান থেকেও জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।
জাপানের কিছু পরিবার গোসলের ব্যবহৃত পানি পরদিন কাপড় বা তোয়ালে ধোয়ার কাজে ব্যবহার করেন। কিন্তু টোকুশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এতে পানি সাশ্রয় হলেও ব্যবহৃত পানির জীবাণু কাপড় ও তোয়ালে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আর যদি তোয়ালে বাথরুমেই শুকাতে দেন, তবে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। কারণ, টয়লেট ফ্লাশ করার সময় বাতাসে ছড়িয়ে পড়া জীবাণু ও ক্ষুদ্র বর্জ্যকণা তোয়ালের ওপর এসে পড়তে পারে।
তোয়ালে যত পুরোনো জীবাণু তত বেশি
দীর্ঘদিন ব্যবহারে তোয়ালে বায়োফিল্ম তৈরি করে, যা হলো জীবাণুর একধরনের জমাট আস্তরণ। এতে কাপড়ের রঙ ও মান নষ্ট হয়। এমনকি নিয়মিত ধোয়া হলেও মাত্র দুই মাসের মধ্যে তোয়ালের উজ্জ্বলতা কমে যেতে পারে।
কী ধরনের জীবাণু থাকতে পারে
বোস্টনের সিমন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী এলিজাবেথ স্কট বলেন, ‘জীবাণু স্বাভাবিকভাবে তোয়ালে থাকে না, এগুলো আসে মানুষের সংস্পর্শ থেকেই।’মানব ত্বকে প্রায় এক হাজারের মতো ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ফাঙ্গাস থাকে। বেশিভাগই উপকারী হলেও কিছু জীবাণু যেমন স্ট্যাফিলোকক্কাস ও ইশেরিশিয়া কোলাই ক্ষতিকর হতে পারে। এসব জীবাণু অন্ত্রে স্বাভাবিকভাবে থাকে, কিন্তু তোয়ালের মাধ্যমে শরীরের অন্য অংশে পৌঁছে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এছাড়াও সালমোনেলা ও শিগেলা-এর মতো ব্যাকটেরিয়া তোয়ালের মাধ্যমে খাদ্যজনিত অসুস্থতা ও ডায়রিয়া ঘটাতে পারে।
সংক্রমণের ঝুঁকি কোথায়
আমাদের ত্বক সংক্রমণের বিরুদ্ধে একটি প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করে। তাই তোয়ালের জীবাণু থেকে ত্বকে সংক্রমণের আশঙ্কা কম। কিন্তু হাত মুছার পর যদি সেই হাত মুখ, নাক বা চোখে লাগে—তাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। রান্নাঘরের তোয়ালেও বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ একই তোয়ালে দিয়ে আমরা হাত, থালা-বাসন ও রান্নার স্থান মুছি—যার মাধ্যমে খাদ্যজনিত রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ভাইরাসও টিকে থাকতে পারে তোয়ালে
গবেষণা বলছে, স্যালমোনেলা, নোরোভাইরাস ও ই কোলাই তোয়ালের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। এমনকি কোভিড-১৯ ভাইরাসও সুতি কাপড়ে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সক্ষম। যদিও এটি সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম নয়, তবুও সতর্ক থাকা জরুরি।
এছাড়া এমপক্স ও এইচপিভি (যা আঁচিল বা ওয়ার্টসের কারণ) তোয়ালে শেয়ার করার মাধ্যমে ছড়াতে পারে। এজন্যই বিশেষজ্ঞরা সংক্রমিত ব্যক্তির তোয়ালে বা বিছানার চাদর ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন। হাসপাতাল ও জনসাধারণের টয়লেটে পুনঃব্যবহারযোগ্য তোয়ালে বাদ দিয়ে একবার ব্যবহারযোগ্য টিস্যু বা এয়ার ড্রায়ার ব্যবহারের কারণও এটি।
কতদিন পর পর তোয়ালে ধোয়া উচিত?
বিশেষজ্ঞ স্কট বলেন, ‘সপ্তাহে অন্তত একবার তোয়ালে ধোয়া উচিত। তবে এটি সবার জন্য একইরকম নয়। কেউ অসুস্থ হলে, যেমন বমি বা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে, তাদের আলাদা তোয়ালে ব্যবহার করা এবং প্রতিদিন তা ধোয়া দরকার। একে আমরা বলি ‘টার্গেটেড হাইজিন’— অর্থাৎ যেখানে ঝুঁকি রয়েছে, সেখানে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
তোয়ালে ধোয়ার সঠিক উপায়
স্কট পরামর্শ দেন, তোয়ালে সাধারণ কাপড়ের তুলনায় বেশি গরম পানিতে (৪০-৬০° সেলসিয়াস) ধোয়া উচিত। এতে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত ধ্বংস হয়। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ডিটারজেন্ট বা জীবাণুনাশক ব্যবহার করলে ফল আরও ভালো পাওয়া যায়।
এ ছাড়া নিম্ন তাপমাত্রায় ধোয়ার ক্ষেত্রে ব্লিচ বা এনজাইমযুক্ত ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা কার্যকর। ভারতের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডিটারজেন্ট ও জীবাণুনাশকের সংমিশ্রণে ধোয়ার পর রোদে শুকালে তোয়ালের ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি কমে।
নিয়মিত তোয়ালে ধোয়ার উপকার
কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যাঁ-ইভ মায়ার বলেন, ‘নিয়মিত তোয়ালে ধোয়া শুধু সংক্রমণ প্রতিরোধই নয়, অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর নির্ভরশীলতাও কমায়। ঘরোয়া পরিচ্ছন্নতা এক ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা, যা নিজের পাশাপাশি অন্যদেরও সুরক্ষা দেয়।’
সূত্র : বিবিসি
মন্তব্য করুন