রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতাল ‘আদ্ব-দীন হাসপাতাল’। দেশের ব্যস্ততম হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম। রোগীরা সেবা ও সহমর্মিতা পেতেই ছুটে যান সেখানে। কিন্তু সেই হাসপাতালে সেবা তো পাননিই বরং দুর্ব্যবহার ও অবহেলার অভিযোগ করেছেন এক প্রসূতি নারী।
সম্প্রতি আদ্ব-দীন হাসপাতালে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা ফেসবুকে শেয়ার করেছেন ওই নারী।
ভুক্তভোগী ওই নারী জানান, ‘আমি যখন সেখানে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলাম, তখন আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে আমি কোনো রোগী নই—বরং হাসপাতালের অপ্রয়োজনীয় বোঝা।’
তার অভিযোগ, হাসপাতালের রিসিপশন থেকে শুরু করে চিকিৎসক-নার্স পর্যন্ত অনেকে রোগীর সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেন। প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চাইলে বিরক্তির সুরে উত্তর দেয়, কখনো আবার অপেক্ষমাণ রোগীদের প্রতি অযথা তাচ্ছিল্যও প্রকাশ করা হয়।
ফেসবুক পোস্টে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি লেখেন, ‘গত ৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা। হঠাৎ আমার পেইন ওঠে। আমার ডেলিভারির মূল তারিখ ছিল ১১ সেপ্টেম্বর। সব প্রক্রিয়া নরমাল থাকায় পুরোপুরি সিদ্ধান্ত থাকে নরমাল ডেলিভারির। আর এজন্যই পারিবারিকভাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল আদ্ব দ্বীন হাসপাতাল।’
ওই নারী নিয়মিত চেকআপ কুর্মিটোলা মেডিকেলে করতেন উল্লেখ করে লেখেন, ‘সবার মতামত ছিল আদ্ব দ্বীন নরমাল ডেলিভারির জন্য ভালো। পরিচিতদের পরামর্শে ভরসাও পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেই ভরসাই পরিণত হলো জীবনের ভয়াল অভিজ্ঞতায়। ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছালাম। সেখানেই শুরু হয় প্রথম ধাক্কা। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে হাসপাতালের বই সংক্রান্ত কিছু প্রক্রিয়া আছে, সেগুলো বানানো নেই, তাই রোগীকে টাচ করা যাবে না। সেসময় আমার প্রচণ্ড পেইনে পানি ভাঙছে। তবু আমাকে বসিয়ে রাখা হলো পুরো ২ ঘণ্টা।’
পুরো সময়টাই তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে জানিয়ে তিনি লেখেন, ‘আধঘণ্টায় বই বানানোর পর ডাক্তারের কাছে গেলেও আমার কাছে আসেননি তারা। দুর্ব্যবহার করে দূরে সরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়। ডাক্তার ৫০ মিটার দূর থেকে একবার দেখলেন। তখন আমি কাতরাচ্ছি, আর ডাক্তার অন্য ডাক্তারের সঙ্গে গল্প চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শেষে নার্সদের হাতে পাঠিয়ে দিলেন।’
তিনি লেখেন, “নার্সরা সেসময় পরিবারকে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সব কিনে আনতে হবে’। এরপর বেবির হার্টবিট চেক হলো। ভয়াবহ জেল ঢেলে তা চেক করা হয়। প্রক্রিয়া শেষের পর জেল মুছতে টিস্যু চাইলে আচরণ করলো ভয়াবহ রকমের খারাপ। মানে- এখানে নবাবী চলে না। বাসা থেকে আনতে পারেন না এমনটাই বললেন।”
‘তারপর শুরু হলো আরেক বিভ্রান্তি। ব্যথায় ছটফটের সময় প্রথমে একজন নার্স বললো পানি ভেঙে বাচ্চা উপরে উঠে গেছে। দ্বিতীয় আরেক নার্স বললো সব ঠিক আছে। তৃতীয় জন এসে বললো পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ বললো পানির মাত্রা ভালো আছে। যা মোটামুটি দেড় ঘণ্টার মধ্যে এমন আজগুবি বয়ান চলে। নানা তালবাহানা শেষে রাত ৩টার দিকে কেবিনে শিফট করা হলো’, তিনি লেখেন।
তিনি আরও লেখেন, ‘রক্ত, ইউরিন টেস্ট দেওয়া হলো। তীব্র ব্যথার কথা বললে নার্স বললো আপনার প্রসাবে ইনফেকশন। মানে একজন ডেলিভারি রোগীকে হাস্যকর বয়ান শোনাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। চেকআপের কারণে রাত ৩টায় রক্ত নিলেও টেস্ট হলো সকাল ৬টায়। রিপোর্ট জমা হলো পরদিন দুপুর ২টায়। রাত ২টার পর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত কোনো ডাক্তার কেবিনে ঢোকেনি। আর এদিকে অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছিলো।’
ওই নারী লেখেন, ‘ওয়াশরুম ব্যবহার শেষে পায়ে পানি ঢালছিলাম। অবশ্য পানি ঢালার নিয়ম তারা রাখেনি কোনো কারণে। যেহেতু আমার দরকার ছিলো পা ধোঁয়ার। পানি ঢালার দৃশ্য দেখে ফেলায় এক আয়া উচ্চস্বরে বললো পেটে বাচ্চা ফেটে মরে যাওয়া উচিত। একজন মায়ের জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ের মুহূর্তে এ ধরনের বয়ান শুনতে হলো।’
ভুক্তভোগী নারী আরও লেখেন, ‘যাকগে শেষে ডাক্তাররা স্যালাইন দিয়ে ব্যথা তোলার সিদ্ধান্ত নিল। আমাকে বুঝিয়েও বললেন। কিন্তু শিফট পরিবর্তন হতেই নতুন ডাক্তার এসে আবার নতুন নাটক শুরু করল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো পিবি না খুললে সিজার লাগবে। কিন্তু পরিবারের সিদ্ধান্ত আদ্ব-দ্বীনে সিজার করাবো না। কারণ আগে থেকেই শুনেছি তাদের সিজারের রোগীদের সেলাই মেলে না, ইনফেকশন হয়, বহু নারী ভোগান্তিতে পড়েন। ঠিক তখনই ডাক্তার লাঞ্চে যাওয়ায় আর দেরি না করে পারিবারিক আলোচনায় কুর্মিটোলা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ছাড়পত্র নিতে সময় লাগলো ৫ মিনিট।’
সবশেষে ভুক্তভোগী আরও লেখেন, ‘আদ্ব-দ্বীনে ২৩ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। খরচ হয়েছে প্রায় ১৫–১৮ হাজার টাকা। কিন্তু এই এক রাতের আতঙ্ক ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। অবশেষে কুর্মিটোলা মেডিকেলে গিয়ে আমরা শান্তি পেয়েছি। পরিশেষে বলব আদ্ব-দ্বীনের মতো প্রতিষ্ঠানের অবহেলা, বিভ্রান্তি আর অমানবিক আচরণ একজন মায়ের জীবন মুহূর্তে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। তাই সাবধান!’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আদ-দ্বীন হাসপাতালের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাহিদ ইয়াসমিন কালবেলাকে বলেন, প্রতিদিন অন্তত ৬০ থেকে ৭০ জন সিজারিয়ান রোগীর ডেলিভারি করা হয়। সাধারণত আমাদের হাসপাতাল থেকে কেউ ডেলিভারি না করে চলে যায় না। আমি এখন যশোরে আছি। যেহেতু এমন অভিযোগ এসেছে এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত খতিয়ে দেখছি।
মন্তব্য করুন