নূর মোহাম্মদ ও মাহমুদা আখতার, নিউইয়র্ক থেকে
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:০৬ পিএম
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:১১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

সামনের কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ : ড. ইউনূস

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : সংগৃহীত
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : সংগৃহীত

জাতিসংঘের আয়োজনে বহুল প্রতীক্ষিত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর)। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সাধারণ পরিষদ হলে এ সম্মেলনটি স্থানীয় সময় সকাল ১০টা (বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা) শুরু হবে। সম্মেলনে অন্তত ৭৫টি দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধির অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানও আছেন।

উদ্বোধন অধিবেশনে বক্তব্য দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ ধরে রাখা, রাজনৈতিক সমর্থন জোরদার করা, মানবাধিকারসহ সংকটের মূল কারণ মোকাবিলা এবং নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি।

বৈঠকে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘের মহাসচিবকে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আগামী কয়েক মাস দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন আয়োজনে আপনাদের (জাতিসংঘ) সহযোগিতা প্রয়োজন।’

এদিকে আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের আগে সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি, মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ দূত এবং অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জুলি বিশপ, ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেলের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেন। সেখানে রোহিঙ্গা সংকট, শিক্ষা, খাদ্য, ফান্ড নিয়ে আলোচনা করেন নোবেলজয়ী ড. ইউনূস।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার, আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত নৃশংসতার দায় নিরূপণ, সংরক্ষণবাদী শুল্ক নীতির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য উদ্বেগ এবং ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশে চলমান গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও সংস্কার উদ্যোগে তার পূর্ণ সমর্থন ও সংহতির অঙ্গীকার করেন জাতিসংঘের মহাসচিব।

প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার পদক্ষেপ এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতের অঙ্গীকার মহাসচিবকে অবহিত করেন।

তিনি অভিযোগ করেন, ক্ষমতাচ্যুত শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসররা চুরি করা অর্থ ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন চায় না। কিছু আন্তর্জাতিক মহলও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলেও জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানান ড. ইউনূস।

এর জবাবে মহাসচিব গুতেরেস বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও সংস্কার কর্মসূচির প্রতি জাতিসংঘের দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বৈশ্বিক পর্যায়ে জাতিসংঘের ধারাবাহিক ভূমিকার প্রতিশ্রুতি দেন। রোহিঙ্গা সম্মেলন আয়োজন করায় জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এ সম্মেলন রোহিঙ্গা সংকটকে বৈশ্বিক আলোচনায় অগ্রাধিকার এবং আশ্রয় শিবিরে মানবিক সহায়তার জন্য জরুরি তহবিল সংগ্রহে ভূমিকা রাখবে। জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজে বের করতে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।

একই দিনে নিউইয়র্কের এক হোটেলে রবার্ট এফ কেনেডি মানবাধিকার সংস্থার সভাপতি কেরি কেনেডির নেতৃত্বে বিভিন্ন মানবাধিক সংস্থার প্রধানরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ড. ইউনূস আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীদের আরও ঘনঘন বাংলাদেশে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্রত্যেকবার আপনারা এলে ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনায় আসে। শেষ পর্যন্ত আপনারাই জনগণের কণ্ঠস্বর।

আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, আমরা চাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হোক অবাধ ও শান্তিপূর্ণ এমন নির্বাচন যা বাংলাদেশে আগে কখনো হয়নি। বছরের পর বছর ভোটার তালিকায় অনেকের নাম থাকলেও তারা ভোট দিতে পারেনি। এবার আমরা বিশেষভাবে নারীদের ভোটদানে উৎসাহিত করতে চাই এবং তাদের অংশগ্রহণ উদযাপন করতে চাই। ভোটদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষকে জানাতে আমরা ব্যাপক প্রচারণা চালাব। আমাদের লক্ষ্য দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা। তবে কিছু আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন প্রধান উপদেষ্টা।

তিনি জানান, কিছু শক্তি রয়েছে যারা চায় না নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। সেজন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালা হচ্ছে, যার সুবিধাভোগী রয়েছে দেশের ভেতরে ও বাইরে। তারা সুসংগঠিত—এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়। অর্থ পাচার রোধে চুরি হওয়া অর্থ প্রতিরোধে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারের আইনি প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। আমি আশা করি, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই বিষয়ে আওয়াজ তুলবে, যেন কোনো ব্যাংক এমন অর্থ লুকিয়ে রাখতে না পারে। এটি সত্যিকার অর্থেই জনগণের অর্থ।

এদিকে এলডিসি থেকে উত্তরণে প্রস্তুতির নিরপেক্ষ মূল্যায়নে জাতিসংঘের সহায়তা চান প্রধান উপদেষ্টা। সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্ক স্থানীয় সময় জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রাবাব ফাতিমা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতে তিনি আহ্বান জানান। বাংলাদেশের অনুরোধে এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়নে সহায়তার ঘোষণা দেন আন্ডার সেক্রেটারি। তিনি আগামী এক মাসের মধ্যেই এ প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানান।

এ সময় অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘উত্তরণের পর সঠিক রূপান্তর পরিকল্পনা না হলে এ খাত ঝুঁকিতে পড়তে পারে।’

একই দিনে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত জুলি বিশপের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকটের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনই একমাত্র কার্যকর সমাধান। দুই নেতার মধ্যে সংকটের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো, যেমন—মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অবনতিশীল মানবিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশে কক্সবাজারে ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাস এবং রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য চলমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নিয়ে গভীর আলোচনা হয়।

প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস উল্লেখ করেন যে, গত ১৮ মাসে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, যা ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিতব্য এই যুগান্তকারী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, শুধু রোহিঙ্গাদের নিয়েই প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই সম্মেলন সংকট সমাধানের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা দেবে। এই আয়োজন আন্তর্জাতিক সমর্থনকে উৎসাহিত করবে, বিশেষ করে বাংলাদেশে থাকা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহে সহায়তা করবে।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেলের সঙ্গে বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস ক্যাম্পের শিক্ষা কার্যক্রমে তহবিল সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, শিক্ষা হারিয়ে ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যা একসময় অপ্রত্যাশিতভাবে বিস্ফোরিত হতে পারে।

এসব বৈঠকে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, এনসিপি নেত্রী তাসনিম জারা এবং এসডিজি সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জনসভায় হামলা-ভাঙচুর গণতন্ত্রের ওপর গভীর হুমকি : জেএসডি

একাধিক চাকরি করলে শিক্ষকদের এমপিও বাতিল

সিলেটকে বাংলাদেশের ১ম দুর্নীতিমুক্ত জেলা ঘোষণার উদ্যোগ

সাবেক সেনা কর্মকর্তার কাছে তারেক রহমানের দুঃখ প্রকাশ

বিএনপি তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ : টুকু

ঢাকায় নেত্রকোনা মুক্ত দিবস উদযাপন

এনসিপির প্রথম ধাপের মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা কাল

যুদ্ধবিমান ইউরোফাইটার টাইফুনের অনন্য যেসব শক্তিমত্তা

যাত্রীদের সুসংবাদ দিল মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ

ব্যাংক কর্মীদের উৎসাহ বোনাস নিয়ে নতুন নির্দেশনা

১০

গুলিবিদ্ধ বিএনপি নেতার খোঁজ নিলেন জামায়াত নেতারা

১১

শাটল ট্রেনে কাটা পড়ে বৃদ্ধের মৃত্যু

১২

চিকিৎসাধীন অবস্থায় চবি ছাত্রদল নেতার মৃত্যু

১৩

‘বিএনপির নামে কেউ চাঁদাবাজি করলে টাকা ফেরত দিতেই হবে’

১৪

ময়লার গাড়িতে সরকারি ওষুধ পাচারের সময় দুই কর্মী আটক

১৫

রাশিয়ায় সামরিক বিমান বিধ্বস্ত, নিহত সব আরোহী

১৬

শারীরিক প্রতিবন্ধী আলিফের পাশে চট্টগ্রামের ডিসি

১৭

‘ইউরোফাইটার টাইফুন’ যুদ্ধবিমান কিনছে বাংলাদেশ

১৮

মসজিদের ভেতর বৃদ্ধের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

১৯

বহিষ্কৃতদের প্রত্যাবর্তনে ছন্দে ফিরছে সিলেট বিএনপি

২০
X