দক্ষ মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। যখন কোনো দেশের বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যাকে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা যায়- তখন তারা প্রাকৃতিক ও মূলধনী সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে পারে, যা বেকারত্ব দূর করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে এবং অর্থনীতিকে টেকসই ও শক্তিশালী করে তোলে।
বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে বস্তুগত সম্পদের চেয়ে মেধাসম্পদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই অর্থনীতির প্রতিটি খাতের জন্য মেধাভিত্তিক মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য ডিজিটাল অর্থনীতির গতি বাড়াতে দক্ষ জনসম্পদ তৈরি ও অবকাঠামো উন্নত করা বেশি জরুরি। আধুনিক বিশ্বে মেধাভিত্তিক সম্পদ যাদের বেশি রয়েছে তারা কৃষি, শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা খাতসহ সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে রয়েছে। যার কারণে অনেক শিল্পোন্নত দেশের কৃষি উৎপাদন কৃষিভিত্তিক দেশের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ৩৭ ভাগ অবদান রাখছে মেধাভিত্তিক সম্পদ। বর্তমানে চীন ও ভারত মেধাভিত্তিক সম্পদ গড়ে তোলার জন্য জাতীয় পর্যায়ে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এক্ষেত্রে বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক এবং যুগোপযোগী করা দরকার বলে মনে করা হচ্ছে।
মানবসম্পদের ৯০ শতাংশই এখনো কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। তাদের যদি মেধাভিত্তিক সম্পদে পরিণত করা যায়, তাহলে সত্যিকার টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এজন্য প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আমূল পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। যদিও দেশে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সৃজনশীলতা বাড়ানোর কোনো সংযোগ নেই। যার কারণে উচ্চশিক্ষার হার বাড়লেও মেধাবী মানবসম্পদের পরিমাণ বাড়ছে না। বাংলাদেশে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে যাওয়ার পথে বড় বাধা ও কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে-আধুনিক প্রযুক্তি ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনবল তৈরি না হওয়া, শিক্ষাব্যবস্থাকে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর অভাব, সঠিক স্কিল বা প্রশিক্ষণের অভাব, কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ এবং বেকারত্ব।
এছাড়া মেধাভিত্তিক সম্পদ তৈরি ও শক্তিশালী ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ার প্রয়োজনীয়তাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে রয়েছে প্রচলিত ও বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এসব চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করতে সরকারি- বেসরকারি খাতে সমন্বিত উদ্যোগ, বৈশ্বিক চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে ১৫-২০ বছরের জন্য কর্মকৌশল নির্ধারণ, কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু এবং একটি স্থায়ী আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ, ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদের সহসভাপতি প্রার্থী সাকিফ শামীম ও বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সভাপতি ফজলে শামীম এহসান। তাদের মতে, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি হলে বেকারত্বের হার কমে আসবে। একটি দেশের অর্থনীতি যত উন্নত হতে থাকে, তার দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদাও তত বাড়ে।
তাই জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হলে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হয়, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে।
অর্থনীতিবিদ এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ ও কর্মসংস্থান টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা রপ্তানি বহুমুখীকরণের কথা বলছি কিন্তু সেভাবে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারছি না। মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশ গার্মেন্টস খাতে হচ্ছে, অথচ এ খাতে আরও ভ্যালু যোগ হতে পারে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, রপ্তানির প্রধান প্রধান খাতগুলো চিহ্নিত করে সেখানে দক্ষ জনবল সরবরাহ করতে হবে। এজন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কারিগরি ও ভোকেশনাল ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে বৈশ্বিক চাহিদা মাথায় রেখেই ১৫-২০ বছরের জন্য কর্মকৌশল নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে ফজলে শামীম এহসান নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী আমরা লোকবল পাই না। অথচ গার্মেন্টসসহ সব খাতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল প্রয়োজন। এই সংকট উত্তরণে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তিনি বলেন, যারা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে চাকরিতে প্রবেশ করতে চায় তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আবার এখন শিল্পকারখানাসহ সর্বক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। এ অবস্থায় অদক্ষ জনবল আরও অযোগ্য হয়ে পড়বেন। এ কারণে আমরা প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছি।
শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অনার্স-মাস্টার্স বা শুধু সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত না হয়ে কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করে চাকরির বাজারে নিজেকে যোগ্য করে তুলুন। বেকারত্ব দূরীকরণ এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী করতে অবশ্যই দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশকিছু উদ্যোগ থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। আরও বেশি তৎপরতা বাস্তবমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।
সাকিফ শামীম বলেন, বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), অ্যাডভান্সড রোবটিক্স, ব্লকচেইন এবং গ্রিন টেকনোলজি’র মতো উচ্চ-মূল্য সংযোজনকারী খাতগুলোতে বিশেষজ্ঞ কর্মীর তীব্র অভাব রয়েছে। দেশের অর্থনীতি যখন কৃষি-নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং এবং সেবা খাতে স্থানান্তরিত হচ্ছে (যা জাতীয় জিডিপিতে প্রায় ৫৩% অবদান রাখে), তখন এই খাতগুলোতে দক্ষতা বৃদ্ধি ব্যতিরেকে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা অসম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, তৈরি পোশাক শিল্পে, যা দেশের রপ্তানির প্রায় ৮২% নিয়ন্ত্রণ করে যেখানে প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়লেও মধ্যম ও উচ্চ স্তরের ব্যবস্থাপকীয় ও কারিগরি পদগুলোতে প্রায়ই বিদেশি কর্মীর ওপর নির্ভর করতে হয়, যা দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে নিয়ে যায়। এই নির্ভরতা কমাতে হলে TVET এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলামকে অত্যাধুনিক শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী ‘রিয়েল-টাইমে’ আপডেটেট করার জন্য একটি স্থায়ী আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি।
এছাড়া বাংলাদেশ বর্তমানে জনসংখ্যাতান্ত্রিক সুবিধার (Demographic Dividend) শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সালের পর থেকে কর্মক্ষম জনসংখ্যার আনুপাতিক হার কমতে শুরু করবে। এই সময়সীমার মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের লক্ষ্য পূরণে এই সুযোগ কাজে লাগানো এক কৌশলগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এফবিসিসিআই নির্বাচন প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হতে পারলে দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। শিল্প-কারখানার চাহিদা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংস্থাগুলোর সহযোগিতা অপরিহার্য। তিনি বলেন, এই ক্ষেত্রে, এফবিসিসিআই (FBCCI) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এফবিসিসিআই বিজনেস স্কুল এবং এফবিসিসিআই এন্টারপ্রেনারশিপ সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষতা উন্নয়নে শিল্পকে সরাসরি যুক্ত করার পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যা কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল ও টেকসই করবে। জনসংখ্যাতাত্বিক সুবিধা কাজে লাগানোর এই শেষ সুযোগে, দক্ষতা ও কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে একটি সুদূরপ্রসারী জাতীয় এজেন্ডা অনুসরণ করা অপরিহার্য।
সাকিফ শামীম আরও বলেন, নীতি নির্ধারকদের উচিত হবে তাৎক্ষণিকভাবে একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেইজ স্থাপন করা, যা রিয়েল-টাইমে দেশীয় শিল্প ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারের চাহিদা বিশ্লেষণ করবে এবং সেই অনুযায়ী TVET কারিকুলাম ও বিনিয়োগের খাত নির্বাচন করবে। পাশাপাশি, TVET প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিল্পের অংশগ্রহণে বাস্তব-ভিত্তিক শিক্ষানবিশ কর্মসূচি (Mandatory Apprenticeship) চালু করে এবং আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন মানদণ্ড (যেমন ISO) অনুসরণ করে TVET-এর গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। সর্বশেষে, নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে SME-এর আনুষ্ঠানিকীকরণ (Formalization) প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে। যা কর্মীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করবে এবং প্রবৃদ্ধিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করবে। এই ডেটা-ড্রিভেন এবং কৌশলগত নীতি সংস্কারের মাধ্যমেই বাংলাদেশ বর্তমান জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা থেকে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক লভ্যাংশ আহরণ করতে সক্ষম হবে এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি সুদৃঢ় হবে। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে, ভবিষ্যতে বিশাল অদক্ষ কর্মক্ষম জনশক্তির বোঝা দেশের অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।
মন্তব্য করুন