অফিসে ঢুকলেই হাজিরা দিয়ে ল্যাপটপ, চার্জার, ওয়াটার বোতল, ডায়েরির সঙ্গে বেরোয় এক জোড়া ইয়ারফোন। মিলেনিয়াল ও জেন জির কর্মজীবনে ইয়ারফোন, হেডফোন বা ইয়ারপড এখন দেহের এক অংশের মতো। অফিসের হট্টগোল হোক বা হোস্টেলের গোলমাল, কানে কিছু না গুঁজে কাজে মন দেওয়া দায়। গান বা সাউন্ডের সঙ্গে কাজের মধ্যে ডুবে যাওয়া হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক অভ্যাস।
কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা কানে ইয়ারফোন বা হেডফোন রাখলে হতে পারে বিপদ। সম্প্রতি দিল্লির এক মহিলার ঘটনা শোনার পর অনেকেই শিউরে উঠেছেন। টানা আট ঘণ্টা ইয়ারপড কানের মধ্যে রাখার পর সামান্য শ্রবণশক্তি হ্রাস দেখা দিয়েছে তার।
বিজ্ঞানের বক্তব্য, হ্যাঁ, তবে কিছু শর্তসাপেক্ষে। আপনি কী ধরনের কাজ করছেন, গানটি কথাসঙ্গত নাকি ইনস্ট্রুমেন্টাল এবং মস্তিষ্ক কীভাবে শব্দ প্রক্রিয়াকরণ করে— সবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের হায়দরাবাদের কেয়ার হসপিটালের স্নায়ুবিশেষজ্ঞ ড. উমেশ টি বলছেন, গান বা শব্দ অনেক সময় মনোযোগ বজায় রাখতে সাহায্য করে, বিশেষত চারপাশ যখন ব্যস্ত বা বিশৃঙ্খল থাকে। কিন্তু তা হওয়া উচিত এমন সাউন্ড যা মন কেড়ে না নেয়।
তিনি যোগ করেন, যারা পড়াশোনা বা লেখার মতো কাজে ব্যস্ত, তাদের ক্ষেত্রে গানের কথা থাকলে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইনস্ট্রুমেন্টাল মিউজিক বা অ্যাম্বিয়েন্ট সাউন্ড বেশি উপযোগী।
আর এক ধরনের শব্দ ‘ব্রাউন নয়েজ’, আজকাল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি এক ধরনের নিম্ন তীব্রতার, লাগাতার শব্দ, যেটি মস্তিষ্কে কোনো নির্দিষ্ট আবেগ বা সুর তৈরি করে না। এতে মন স্থির থাকে, কাজের গতি বজায় থাকে। ADHD বা মনোযোগ ঘাটতিতে ভোগা ব্যক্তিদের জন্যও এটি উপকারী বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
তবে এখানে সাবধানতা জরুরি, যদি মস্তিষ্ক অভ্যস্ত হয়ে যায়, শুধু কোনো সাউন্ড থাকলেই মন বসে, তবে নীরবতা একসময় বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। মাঝে মাঝে একেবারে কোনো শব্দ ছাড়াই কাজ করার অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার।
ইয়ারফোন ব্যবহারের বিপদ কী কী?
কানেই তো দিচ্ছি, তা-ও আবার দামি কোম্পানির। কী-ই বা ক্ষতি হতে পারে? ভাবনাটা এমন হলে ভুল করবেন। কারণ গান শোনা বা পডকাস্ট প্লে করে কাজ করার অভ্যাস থাকলেও, টানা অনেকক্ষণ ইয়ারফোন ব্যবহার করা শরীরের পক্ষে মোটেই নিরাপদ নয়। কানের গঠনের সঙ্গে মিল না থাকলে, ইয়ারফোনের খাপ না খেলে অস্বস্তি, অ্যালার্জি এমনকি কানে সূক্ষ্ম চোটও হতে পারে।
আর মোমের কথা ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের কান স্বাভাবিক নিয়মে মোম বের করে দেয়। ‘কিন্তু বারবার ইয়ারফোন ব্যবহার করলে সেই মোম ভিতরের দিকে ঠেলে যায়, পাশাপাশি কানের বাইরের প্রাকৃতিক আর্দ্রতাও হারায়। এতে কান শুষ্ক হয়ে সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে। সামান্য শ্রবণশক্তি কমার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে,’ যোগ করেন বেঙ্গালুরুর গ্লেনিগলস BGS হাসপাতালের ইএনটি বিশেষজ্ঞ ড. মঞ্জুনাথ এম কে।
তিনি আরও বলেন, যারা নিয়মিত পরিবেশের স্বাভাবিক শব্দ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন ইয়ারপ্লাগ বা ইয়ারবাড ব্যবহার করেন, তাদের মস্তিষ্ক একসময় স্বাভাবিক শব্দ শোনার অভ্যাস হারায়। ফলে পরবর্তী সময়ে ছোটোখাটো শব্দও অসহ্য মনে হতে পারে, তৈরি হয় অডিটরি হাইপারসেনসিটিভিটি।'
তবে কতক্ষণ হেডফোন কানে রাখা নিরাপদ?
চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো, ‘৬০/৬০ নিয়ম’, ৬০ শতাংশ ভলিউমে একটানা সর্বোচ্চ ৬০ মিনিট।
ইয়ারফোন ব্যবহারসংক্রান্ত সচেতনতা
১. প্রতি আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা অন্তর অন্তত ৫-১০ মিনিট কানকে বিশ্রাম দিন
২. ইয়ারফোন পরিষ্কার রাখুন
৩. গভীরে ঠেলে দেবেন না
৪. মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ নীরবতায় কাজ করুন
৫. ভলিউম কম রাখুন
ঘন ঘন এবং দীর্ঘ সময় ইয়ারফোন ব্যবহার শুধু কানের ক্ষতি করছে না, মনোযোগ ধরে রাখার স্বাভাবিক ক্ষমতাও কমাচ্ছে। এখনই সতর্ক না হলে, ভবিষ্যতে মস্তিষ্কই হয়তো নীরবতার গুরুত্ব বুঝতে পারবে না।
সূত্র : দ্য ওয়াল
মন্তব্য করুন