চার বছর আগে এক গবেষণায় জানা গিয়েছিল- বাংলাদেশে রান্নায় ব্যবহৃত হলুদে ক্ষতিকারক সিসা মেশানোর কথা। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ ওই গবেষণায় উঠে আসে- বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সিসা দূষণের একটি প্রধান উৎস হলুদে ভেজাল। তবে বর্তমানে সেই চিত্র বদলে গেছে, রান্নার হলুদে এখন সিসা মেশানো হচ্ছে না।
মারজিনাল রেভুলেশনে প্রকাশিত জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক অ্যালেক্স তাবারকের এক প্রতিবেদনে এ সুখবর জানানো হয়েছে। এর আগে রান্নার হলুদে সিসা মেশানো নিয়েও গত বছর প্রতিবেদন করেছিলেন অ্যালেক্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হলুদে সিসা মেশানো নিয়ে গবেষণাটি ২০১৯ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর সতর্কবার্তা জারি করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয় আইনি ব্যবস্থাও। যার ফলে এখন আর হলুদে সিসা মেশানো হচ্ছে না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একাডেমিক গবেষণায় উঠে আসা কোনো বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সফলতার উজ্জ্বল এক উদাহরণ হতে পারে হলুদ থেকে সিসার উপস্থিতি হ্রাস।
সিসা দূষণের শিকারের তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রভাবও পড়েছে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ওপর। প্রায় ৭০ শতাংশ বুদ্ধিবৃত্তিক পঙ্গুত্ব সিসার কারণে হয়ে থাকে। গড়ে বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের রক্তে ৬ থেকে ৮ মাইক্রোগ্রাম সিসা/ডেসিলিটার এ পাওয়া গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মাত্রা পাঁচের থেকে অনেক বেশি।
আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় বলা হয়, ২০১২-১৩ সালের দিকে বাংলাদেশের ৯ জেলায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের রক্তে সিসার পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। এরপর সংস্থাটি এই সিসার উৎস খুঁজতে নানা ধরনের নমুনা সংগ্রহ করে। পরে হলুদে সিসার মিশ্রণ খুঁজে পায় তারা।
পরে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে দেখা যায়- এই সিসার উৎস অবৈধভাবে ব্যবহৃত রং বা উজ্জ্বলকারক লেড ক্রোমেট। স্থানভেদে এই লেড ক্রোমেটকে স্থানীয়ভাবে পিউরি, বাসন্তি রং, কাঁঠালি বা সরষে ফুল নামে পরিচিত।
অ্যালেক্স জানিয়েছেন, গল্পটির শুরু পিএইচডি শিক্ষার্থী জেনা ফোরসিথের সঙ্গে। রান্না করার জন্য ব্যবহৃত হলুদে সিসা পাওয়ার বিষয়টি উঠে আসে মূলত তারই গবেষণায়।
২০১৪ সালে জেনা ফোরসিথ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও সম্পদ বিষয়ে তার পিএইচডি শুরু করেন। তিনি যখন গবেষণাটি শুরু করেন তখন হলুদে সিসা ক্রোমেট মেশানোর বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। জেনা পরিবেশ, পানি ও স্যানিটেশন বিষয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী ছিলেন এবং এ বিষয়ে কাজ করার জন্য তিনি বিশ্বখ্যাত বিশেষজ্ঞ স্টিফেন লুবির সঙ্গে দেখা করেন।
কিন্তু স্টিফেন লুবি জেনাকে পানি ও স্যানিটেশন বিষয়ের পরিবর্তে বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ দেন এবং তিনি নিজে বাংলাদেশে কাজ করতে গিয়ে একটি ধাঁধায় পড়েছেন বলে জানান। তিনি জেনাকে জানান, বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং শিশুদের রক্তে উচ্চমাত্রার সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই সিসার উৎস কী সেটা অজানা। এমনকি সেখানে সিসা ছড়াতে পারে এমন কোনো কারণ নেই। আশপাশে কোনো ব্যাটারি রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট নেই অথবা কোনো বাড়িতে রঙও করা হয়নি। তাহলে এই সিসার উপস্থিতি! এটা কীভাবে সম্ভব?
জেনা ও তার সহযোগীরা বাংলাদেশের খাদ্যপণ্য এবং বিভিন্ন ধরনের মসলা পরীক্ষা করা শুরু করেন। অবশেষে তারা রান্নার গুঁড়া হলুদে সিসার অস্তিত্ব খুঁজে পান। জেনা ও তার সহযোগীরা ল্যাবে শুধু হলুদ পরীক্ষা করে থেমে থাকেননি; তারা বাংলাদেশের মাটিও পরীক্ষা করেন।
তারা হলুদ প্রক্রিয়াকরণ মিল পরিদর্শন করে পলিশিং মেশিন এবং মিলের মেঝে থেকে ধুলোর নমুনা সংগ্রহ করেন। অবশেষে তারা দেখতে পান- মিলগুলোতে হলুদ প্রক্রিয়াকরণের সময় হলুদের রঙ আরও উজ্জ্বল করতে এবং পরিমাণ বাড়াতে সিসা মেশানো হচ্ছে।
২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে সবচেয়ে বেশি হলুদ উৎপাদন করা হয় এমন ৯টি জেলা থেকে ১৪০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে সাতটি জেলা থেকে হলুদে ক্রোমেট পাওয়া গেছে। ওই বছর জেনা ও তার দল তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। তারপর সেটি নিয়ে তারা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাছে যান।
গবেষক দল নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। অধিদপ্তরের তৎকালীন চেয়ারম্যান সৈয়দা সারোয়ার জাহান তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেন এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে সতর্কবার্তা প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন।
জনসচেতনতা তৈরির জন্য স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে জেনা ফোরসিথের নতুন গবেষণার ফলাফল প্রচার করা হয়। হলুদে সিসার ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করতে ব্যবসয়ীদেরও সতর্ক করা হয়। দেশের বৃহৎ পাইকারী মসলার বাজারগুলোতে নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়। ভেজাল এবং সিসা মিশ্রিত হলুদ বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কার্যকর পদক্ষেপের কারণে এখন আর হলুদে সিসা মিশছে না।
মন্তব্য করুন