এম হুমায়ুন কবির
  ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০৮:০০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
সাক্ষাৎকারে এম হুমায়ুন কবির

ব্রিকসের সদস্য হওয়া বা না হওয়ায় বাংলাদেশের খুব একটা পরিবর্তন আসবে না

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এম হুমায়ুন কবির। ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন।

তিনি সেপ্টেম্বর-২০১০ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সচিব পদে অবসর গ্রহণ করেন। ব্রিকস সম্মেলন ও এতে বাংলাদেশের যোগদান নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

কালবেলা : এবারের ব্রিকস সম্মেলনটিকে কেন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে?

এম হুমায়ুন কবির : এবারের ব্রিকস সম্মেলনটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। তার কয়েকটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। একটি কারণ হলো- ব্রিকস সংগঠনটি কয়েকটি জনবহুল দেশ- চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। ভারত এবং ব্রাজিলও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদন ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে চীনের অবদান ১৯ শতাংশ। ভারতের অবদান প্রায় ৩ শতাংশ। এই দুটো দেশের বিশ্ব অর্থনীতিতে ২২ শতাংশের মতো অংশগ্রহণ আছে। কাজেই জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির শক্তির ভিত্তিতে ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনটি ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলন। এর আগে অনুষ্ঠিত ১৪টি সম্মেলন নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এতে করে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত বিশ্বের অনেক দেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর প্রেক্ষাপটে ডলার আধিপত্য হ্রাস এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে ব্রিকস নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বস্তুত ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পৃথিবী মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা জগত রাশিয়ার ভূমিকা নিন্দা করে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে রাশিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করে ইরান, বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, নিকায়ারাগুয়ার মতো দেশগুলো পশ্চিমাদের ভূমিকাকে নিন্দা করছে। এর পাশাপাশি চীন-ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা-ব্রাজিলসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ এক্ষেত্রে পশ্চিমা জগত ও রাশিয়া থেকে সম-দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

১৫তম ব্রিকস সম্মেলন মূলত দুটি বিষয়কে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার একটি হলো, পশ্চিমা বিশ্ব তথা ডলারের প্রভাব কমিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বিকল্প কাঠামো তৈরি করা এবং সে সঙ্গে ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতির কাঠামোতে একটি নতুন মেরুর সঞ্চার করা।

এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, ব্রিকসের এ প্রচেষ্টা অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে বিকল্পধারা তৈরি করার চীনা প্রচেষ্টার সঙ্গে অনেকটাই সাজুস্যপূর্ণ বলে অনেকে মনে করেন। ফলাফলের দিক থেকে বিবেচনা করলে এবারের ব্রিকস সম্মেলনকে সফল সম্মেলন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ব্রিকসের নেতৃবৃন্দ ছয়টি নতুন দেশকে এ সংস্থার সদস্য হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। এ ছয়টি দেশের মধ্যে আফ্রিকা থেকে দুটি দেশ- মিশর এবং ইথিওপিয়া, মধ্যপ্রাচ্য থেকে তিনটি দেশ- ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ল্যাটিন আমেরিকা থেকে একটি দেশ- আজেন্টিনা এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এলডিসি সদস্যভুক্ত দেশ ইথিওপিয়ার অন্তর্ভুক্তি খানিকটা প্রশ্নের উদ্রেক করলেও অনেক বিশ্লেষক আফ্রিকার একাত্মতা এবং ব্রিকসের এবারের সম্মেলনের মূল বক্তব্য- ব্রিকস এবং আফ্রিকার মধ্যে পার্টনারশিপের অনুপ্রেরণাতেই তেমনটা ঘটেছে বলে মনে করেন। অপরদিকে আর্জেন্টিনা বাদে অপর দেশগুলো তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে ভূ-কৌশলগত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তিতে কাজ করে থাকবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। ল্যাটিন আমেরিকার ভৌগোলিক বিবেচনায় আজের্ন্টিনার অন্তর্ভুক্তি হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

কালবেলা : ব্রিকসে পশ্চিমা কোনো দেশ নেই। তাহলে কি বলা যায় এটা পশ্চিমাবিরোধী জোট?

এম হুমায়ুন কবির : এই জোটের নেতৃবৃন্দ বলেছেন যে, তারা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে নয়; কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের অবস্থান এ বক্তব্যের অনেক ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কাজেই পশ্চিমাদের কেউ যদি মনে করেন যে, ব্রিকসের বক্তব্য চীন ও রাশিয়ার অবস্থানের কাছাকাছি তাহলে খুব বেশি ভুল বলা হবে না। তবে এখানে ভারত আছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কটি ভূ-রাজনীতির কারণে খুব সহজ নয়। চীন ও ভারত ছাড়া অন্য যে দেশগুলো ব্রিকসে আছে তাদের অর্থনীতি যে খুব বেশি শক্তিশালী বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা মনে হয় না। যদিও বলা হচ্ছে, ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলো বৈশ্বিক জিডিপির ২৫ শতাংশের মতো তাদের আওতায় রেখেছে এবং তাদের ব্যাপক জনসংখ্যাও আছে। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক যে কাঠামো আছে তাতে তারা খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন এখনো অজানা।

কালবেলা : ব্রিকসে বাংলাদেশ সদস্য পদের জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু পায়নি। এটাকে কীভাবে দেখেন?

এম হুমায়ুন কবির : এক্ষেত্রে আমি দুটি বিষয়ের কথা বলব। একটি হচ্ছে, ব্রিকসে নতুন করে যেসব দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে ইথিওপিয়া ছাড়া বাকি সবাই এলডিসির ওপরে উন্নয়নশীল দেশ। সে বিবেচনায় হয়তো তারা বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে বিবেচনা করেনি। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে আমরা আমাদের আগ্রহ দেখিয়েছি কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন তা যথাযথ হয়েছে কিনা, সে বিষয়টি আমি জানি না। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির বিবেচনায় বাংলাদেশের ব্রিকসের সদস্য হওয়া তা বাস্তব অর্থে আমাদের জন্য খুব একটা পরিবর্তন আনবে বলে অনেকে মনে করেন না। তার কারণ হলো, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্রিকসের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য চীন এবং ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক মোটামুটি ভালো। তবে যেহেতু ব্রিকসের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের জোরালো কোনো অর্থনৈতিক যোগাযোগ নেই সে কারণে ব্রিকসের সদস্যপদ এ মুহূর্তে না পেলেও বাংলাদেশের ক্ষতির তেমন কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।

কালবেলা : ব্রিকসে যোগদান করলে পশ্চিমা দেশগুলোতে আমাদের রপ্তানিতে কোনো প্রভাব পড়ার শঙ্কা ছিল কী?

এম হুমায়ুন কবির : সে প্রভাবটা পড়বে বলে আমি মনে করি না। তবে তারা নিশ্চয়ই আমরা ব্রিকস নিয়ে কী ভাবছি, ব্রিকসের প্রতি আমাদের আগ্রহ কতটা এসব বিষয়ে মনোযোগ রাখছে। কারণ, এই মুহূর্তে ব্রিকসের নেতারা যে ধরনের কথাবার্তা বলছেন সেই কথাগুলো পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে খুব ইতিবাচক ঠেকবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে ব্রিকস সম্মেলনে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে তার যুদ্ধের পক্ষে যে সাফাই গেয়েছেন সেটি পশ্চিমা বিশ্ব ভালোভাবে নেবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে চীন ও ভারত সরাসরি রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য দায়ী করেনি এবং নিন্দাও জানায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকাও একই অবস্থান গ্রহণ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক যে ঘটনাপ্রবাহ তৈরি হচ্ছে সেসব বিষয়ে ব্রিকসের অবস্থান পশ্চিমাদের খুব খুশি করবে তেমনটা মনে হয় না।

কালবেলা : বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম বিশ্ব চাপ দিচ্ছে তখনই আমরা ব্রিকসের সদস্যপদ লাভের জন্য তৎপর হয়ে উঠলাম। এটি কি কোনো বার্তা প্রদান করছে?

এম হুমায়ুন কবির : আমি বলব রাজনীতি দিয়ে কূটনীতি না করাই ভালো। তবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের চাহিদা। তার প্রতি সবার সম্মানজনক অবস্থান থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিতর্কিত জলসীমায় চীন-ফিলিপাইনের জাহাজের সংঘর্ষ

চট্টগ্রামে মেয়রের গাড়ির ধাক্কায় ২ পুলিশ সদস্য আহত

যেভাবে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’-এর পলাশের কাছে পৌঁছলেন সেই ভক্ত

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল বুটেক্স শিক্ষার্থীর

বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন করলে ভোট বাতিল : ইসি

এসএসসি পরীক্ষার সম্ভাব্য সময় জানা গেল

ইসরায়েল নামক দুষ্ট ছেলে ‘আমেরিকার সন্তান’ : ওবায়দুল কাদের

ফুটবলে বিকেএসপি নিষিদ্ধ

হুমকির ‍মুখে জীববৈচিত্র্য / জাতীয় উদ্যানে কভারবিহীন বৈদ্যুতিক তার, বন্যপ্রাণীর মরণ ফাঁদ!

ডেঙ্গুতে ৯ মৃত্যু

১০

হাউজিংয়ের খেলার মাঠ প্লট আকারে বিক্রি করা যাবে না : মেয়র আতিক

১১

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ডিআরইউ নেতৃবৃন্দের শ্রদ্ধা

১২

গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদই ইসরায়েলের লক্ষ্য : জর্ডান

১৩

ঝুঁকিপূর্ণ পিচ, পরিত্যক্ত বিগ ব্যাশের ম্যাচ

১৪

জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণের সময় জানাল ইসি

১৫

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এসএসসি পরীক্ষার রুটিনটি ভুয়া

১৬

৪৬তম বিসিএসের আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু

১৭

বালু তুলতে গিয়ে প্রাণ গেল শ্রমিকের

১৮

পর্যটকসহ ডুবোচরে আটকে গেল সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ

১৯

আলিয়া আমার প্রথম স্ত্রী নয়, আমি আমার প্রথম স্ত্রীকে দেখিনি : রণবীর

২০
X