২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোড থেকে অফিস করে বাসায় ফিরছিলেন ব্যাংকার নাজমুল কবীর। পথে মেরুল বাড্ডা বৌদ্ধমন্দিরের সামনে দুজন অস্ত্রধারী তার মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক তিনি বাড্ডা থানায় গিয়ে জিডি করেন। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। পুলিশ জানায়, সেখানে তাদের কোনো সিসি ক্যামেরা নেই ও আশপাশের ভবনের সিসি ক্যামেরা ঘটনাস্থলকে কাভার করে না। ঘটনার চার বছর অতিবাহিত হলেও মোবাইল বা মানিব্যাগ কিছুই ফেরত পাননি তিনি।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হন বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত জামিনুর রহমান সুমন। তাৎক্ষণিক শাহবাগ থানায় বিষয়টি জানান তিনি। জানা গেছে, ছিনতাই হওয়া জিনিসপত্রের এখনো কোনো সন্ধান পাননি সুমন।
সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের শিকার হন সাংবাদিক আহমাদ ওয়াদুদ। থানায় অভিযোগ দাখিল করতে গিয়েও বিড়ম্বনার শিকার হয়ে বাসায় ফিরে ফেসবুকে নিজের ভোগান্তির কথা জানিয়ে দেন বড় এক স্ট্যাটাস। তারপর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওপর মহল থেকে বারবার কল আসতে থাকে তার কাছে।
রাত শেষে সকাল হতে হতে পোস্টটি রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়। নেটিজেনরা নানা সমালোচনায় মেতে ওঠেন। এদিকে বাড়তে থাকে পুলিশের দৌড়ঝাঁপ।
দুপুরের পর টিভির স্ক্রলে ভেসে ওঠে এ ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিনজনকে আটক করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। একই সঙ্গে আহমাদ ওয়াদুদের মোবাইলটিও উদ্ধার হয়েছে।
চলতি বছরের ৬ মার্চ মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুরবাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয় আট বছরের শিশু আছিয়া। পরে ১৩ মার্চ ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে মারা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরালের পর আছিয়ার এ ঘটনায় সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ।
কিন্তু প্রতিনিয়ত সারা দেশে এমন অসংখ্য 'আছিয়া' ধর্ষণের শিকার হচ্ছে; কিন্তু সেসব ঘটনা থেকে যাচ্ছে আড়ালে। ভুক্তভোগী পরিবারও অনেক সময় ভয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারে না। সেসব ঘটনায় তদন্ত বা গ্রেপ্তার বিচার কতদূর হয়, সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কারণ বিষয়টি তো আর ভাইরাল হয়নি।
কিছুদিন আগে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদও প্রকাশ হয় যে, রাজধানীতে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা। পরে হত্যার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ব্যাস, শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। কেন খুন হলো ব্যবসায়ী সোহাগ, কারা জড়িত ছিল, কী ছিল তার রাজনৈতিক পরিচয়—একে একে বের হতে থাকে সেসব তথ্য।
এরই মাধ্যে সোহাগের দাফনের পর তার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপের সময় তিনি অভিযোগ করেন, থানায় মামলা দিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তিনি। কয়েকবার এজাহার নাকি বদল করতে হয়েছে।
২০২২ সালের ২৩ মার্চ শেরপুরের শ্রীবরদীতে পুলিশের সামনেই শেখবর আলী নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ১৮ দিন পর একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। তারপর পুলিশের এসআই ওয়ারেস আলীকে পুলিশ লাইন্সে ক্লোজ করা হয়।
২০২১ সালে রাজধানীর বিজয় সরণি থেকে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের হাত থেকে আইফোন ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী। পরে সেটি উদ্ধারও হয়। কারণ তিনি তো আর ‘আমজনতা’ না।
এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে, তাহলে কি বিচার পেতে গেলে আগে ভাইরাল হতে হবে। আর ভাইরালের মানযন্ত্রটা আসলে কী তাহলে। যদি কোনো ঘটনা ভাইরাল না হয়, তাহলে সেটি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাধারণ নাগরিকের জীবন বা নিরাপত্তার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ আর ‘শেয়ার’।
ভাইরাল হলেই শুধু বিচার শুরু হয়, এমন একটা বাস্তবতা দাঁড়িয়ে গেছে সমাজে। এই প্রথার পেছনে রয়েছে প্রশাসনের কাঠামোগত দুর্বলতা। প্রথমত, পুলিশের জনবল ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি। দ্বিতীয়ত, দায়িত্বশীলতার অভাব—যতক্ষণ না জনরোষের ভয় থাকে, ততক্ষণ প্রশাসনের তৎপরতা থাকে না। তৃতীয়ত, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের দূরত্ব।
আমাদের উচিত পুলিশের দিকে আঙুল না উঁচিয়ে পুরো সিস্টেমের দিকে আঙুল তোলা। অনেক সময় দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার কাউকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে বলা হয় আগে পুলিশে অভিযোগ জানান, তারপর চিকিৎসা। এমন নজিরও আছে আমাদের দেশে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক বেশিই আমাদের।
নাগরিক নিরাপত্তা সবার আগে জরুরি, কারণ নাগরিকই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই নাগরিক। সুতরাং ঘটনা ঘটে ভাইরাল হয়ে জনরোষে কাজ না করে জনগণের জন্য আগে থেকেই কাজ করা উচিত।
মন্তব্য করুন