নূরে আলম সিদ্দিকী
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ০২:৪১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বিচার পেতে গেলে কি ভাইরাল হতে হবে?

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোড থেকে অফিস করে বাসায় ফিরছিলেন ব্যাংকার নাজমুল কবীর। পথে মেরুল বাড্ডা বৌদ্ধমন্দিরের সামনে দুজন অস্ত্রধারী তার মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক তিনি বাড্ডা থানায় গিয়ে জিডি করেন। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। পুলিশ জানায়, সেখানে তাদের কোনো সিসি ক্যামেরা নেই ও আশপাশের ভবনের সিসি ক্যামেরা ঘটনাস্থলকে কাভার করে না। ঘটনার চার বছর অতিবাহিত হলেও মোবাইল বা মানিব্যাগ কিছুই ফেরত পাননি তিনি।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হন বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত জামিনুর রহমান সুমন। তাৎক্ষণিক শাহবাগ থানায় বিষয়টি জানান তিনি। জানা গেছে, ছিনতাই হওয়া জিনিসপত্রের এখনো কোনো সন্ধান পাননি সুমন।

সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের শিকার হন সাংবাদিক আহমাদ ওয়াদুদ। থানায় অভিযোগ দাখিল করতে গিয়েও বিড়ম্বনার শিকার হয়ে বাসায় ফিরে ফেসবুকে নিজের ভোগান্তির কথা জানিয়ে দেন বড় এক স্ট্যাটাস। তারপর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওপর মহল থেকে বারবার কল আসতে থাকে তার কাছে।

রাত শেষে সকাল হতে হতে পোস্টটি রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়। নেটিজেনরা নানা সমালোচনায় মেতে ওঠেন। এদিকে বাড়তে থাকে পুলিশের দৌড়ঝাঁপ।

দুপুরের পর টিভির স্ক্রলে ভেসে ওঠে এ ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিনজনকে আটক করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। একই সঙ্গে আহমাদ ওয়াদুদের মোবাইলটিও উদ্ধার হয়েছে।

চলতি বছরের ৬ মার্চ মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুরবাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয় আট বছরের শিশু আছিয়া। পরে ১৩ মার্চ ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে মারা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরালের পর আছিয়ার এ ঘটনায় সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ।

কিন্তু প্রতিনিয়ত সারা দেশে এমন অসংখ্য 'আছিয়া' ধর্ষণের শিকার হচ্ছে; কিন্তু সেসব ঘটনা থেকে যাচ্ছে আড়ালে। ভুক্তভোগী পরিবারও অনেক সময় ভয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারে না। সেসব ঘটনায় তদন্ত বা গ্রেপ্তার বিচার কতদূর হয়, সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কারণ বিষয়টি তো আর ভাইরাল হয়নি।

কিছুদিন আগে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদও প্রকাশ হয় যে, রাজধানীতে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা। পরে হত্যার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ব্যাস, শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। কেন খুন হলো ব্যবসায়ী সোহাগ, কারা জড়িত ছিল, কী ছিল তার রাজনৈতিক পরিচয়—একে একে বের হতে থাকে সেসব তথ্য।

এরই মাধ্যে সোহাগের দাফনের পর তার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপের সময় তিনি অভিযোগ করেন, থানায় মামলা দিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তিনি। কয়েকবার এজাহার নাকি বদল করতে হয়েছে।

২০২২ সালের ২৩ মার্চ শেরপুরের শ্রীবরদীতে পুলিশের সামনেই শেখবর আলী নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ১৮ দিন পর একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। তারপর পুলিশের এসআই ওয়ারেস আলীকে পুলিশ লাইন্সে ক্লোজ করা হয়।

২০২১ সালে রাজধানীর বিজয় সরণি থেকে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের হাত থেকে আইফোন ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী। পরে সেটি উদ্ধারও হয়। কারণ তিনি তো আর ‘আমজনতা’ না।

এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে, তাহলে কি বিচার পেতে গেলে আগে ভাইরাল হতে হবে। আর ভাইরালের মানযন্ত্রটা আসলে কী তাহলে। যদি কোনো ঘটনা ভাইরাল না হয়, তাহলে সেটি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাধারণ নাগরিকের জীবন বা নিরাপত্তার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ আর ‘শেয়ার’।

ভাইরাল হলেই শুধু বিচার শুরু হয়, এমন একটা বাস্তবতা দাঁড়িয়ে গেছে সমাজে। এই প্রথার পেছনে রয়েছে প্রশাসনের কাঠামোগত দুর্বলতা। প্রথমত, পুলিশের জনবল ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি। দ্বিতীয়ত, দায়িত্বশীলতার অভাব—যতক্ষণ না জনরোষের ভয় থাকে, ততক্ষণ প্রশাসনের তৎপরতা থাকে না। তৃতীয়ত, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের দূরত্ব।

আমাদের উচিত পুলিশের দিকে আঙুল না উঁচিয়ে পুরো সিস্টেমের দিকে আঙুল তোলা। অনেক সময় দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার কাউকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে বলা হয় আগে পুলিশে অভিযোগ জানান, তারপর চিকিৎসা। এমন নজিরও আছে আমাদের দেশে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক বেশিই আমাদের।

নাগরিক নিরাপত্তা সবার আগে জরুরি, কারণ নাগরিকই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই নাগরিক। সুতরাং ঘটনা ঘটে ভাইরাল হয়ে জনরোষে কাজ না করে জনগণের জন্য আগে থেকেই কাজ করা উচিত।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভাঙন, শতাধিক ঘরবাড়ি প্লাবিত

কলাবাগানে ৬ তলা থেকে পড়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

আ.লীগের লোকদের সঙ্গে কেউ চলাফেরা করবেন না : মেজর হাফিজ 

রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব উপস্থাপন

ডেঙ্গুতে একদিনে আরও ৩ মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৪০৯

পুলিশের ৯ কর্মকর্তাকে রদবদল

চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় ১০৭ মিলিমিটার বৃষ্টি

বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বাড়ছে ভারতীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা

ফিলিস্তিনিদের চাকরি দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফে সিলগালা

সাংবাদিককে আ.লীগ নেতার প্রাণনাশের হুমকি

১০

এক ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়, দলগুলো একমত

১১

ছাত্র ভর্তির নামে ঘুষগ্রহণ, অফিস সহকারী বরখাস্ত

১২

সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে মাঝ আকাশে ‘ডুব’ দিল বিমান

১৩

হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকতাম : আমীর খসরু

১৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪ জন সাতদিনের রিমান্ডে

১৫

রাজ্জাককে নিয়ে স্ট্যাটাস সরিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন মাহিন

১৬

ছোট পর্দায় ‘তাণ্ডব’

১৭

একনেকে অনুমোদন পেল ঢাবির ২৮শ কোটির মেগা প্রকল্প

১৮

ভিয়েনার রেস্তোরাঁয় হিব্রু বলে বিপদে ইসরায়েলি মিউজিশিয়ান

১৯

৩০ সেকেন্ডের ঘূর্ণিঝড়ে সব লন্ডভন্ড

২০
X