জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অর্থ ব্যবস্থাপনার চাহিদা ভিন্ন। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত আমাদের আর্থিক বাস্তবতা, দায়বদ্ধতা ও আকাঙ্ক্ষা বদলায়। বাংলাদেশে যেখানে অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগও বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনা ও অর্থ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি দিন দিন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনাকে একটি গাছের সঙ্গে তুলনা করা যায়—যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শিকড় গড়ে, ডালপালা ছড়িয়ে পূর্ণতা লাভ করে। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা যায়, তবে সারা জীবন আর্থিক নিরাপত্তা এবং মানসিক শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। চলমান বাস্তবতায় এটিকে সাতটি ধাপে ভাগ করে পরিকল্পনা করা যেতে পারে।
প্রথম ধাপ (০–১৮ বছর): আর্থিক সাক্ষরতার ভিত্তি
জীবনের শুরুতেই আর্থিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছোটবেলা থেকেই খরচ ও সঞ্চয়ের পার্থক্য শেখানো হলে দায়িত্বশীল প্রজন্ম গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের জন্য সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট চালু করেছে, যা আর্থিক সাক্ষরতার বীজ বপন করছে।
এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের সকল শাখা ও উপশাখাকে অন্তত একটি করে স্কুলে আর্থিক সাক্ষরতা ও স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কার্যকর উদ্যোগ শিশুদের মধ্যে সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ দেখলে দেখা যায়, জাপান, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিশুদের পকেটমানি ব্যবস্থাপনা শেখানো হয়। খরচ, সঞ্চয়, চ্যারিটি এবং বাজেট পরিকল্পনার মতো বিষয়গুলো শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। বাংলাদেশেও স্কুল পর্যায়ে এমন উদ্যোগ বাধ্যতামূলক হলে শিশুরা অল্প বয়সেই অর্থের মূল্য বুঝতে শিখবে এবং ভবিষ্যতে আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে।
দ্বিতীয় ধাপ (১৮–২৫ বছর): আর্থিক স্বাধীনতার শুরু
এই বয়সে তরুণরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কিংবা কর্মজীবনে প্রবেশ করে। তাই শুরু থেকেই সঠিক বাজেট পরিকল্পনা শেখা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বহুল আলোচিত ৫০/৩০/২০ ‘মানি ম্যানেজমেন্ট রুল’—যেখানে আয়ের ৫০% ব্যয় হয় প্রয়োজনীয়তায়, ৩০% ব্যয় হয় ইচ্ছা পূরণে এবং বাকি ২০% যায় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে—এটি তরুণদের আর্থিক শৃঙ্খলা গড়ে তোলার জন্য নিঃসন্দেহে সবচেয়ে কার্যকর একটি পদ্ধতি।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পার্টটাইম কাজের সুযোগ সীমিত, তবে ফ্রিল্যান্সিং ও স্টার্টআপ উদ্যোগ তরুণদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তরুণরা পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করে নিজেদের টিউশন ফি বহন করে। এতে আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি পায় এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার ফ্রিল্যান্সারের অধিকাংশই তরুণ, যারা অনলাইনে আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে কাজ করে আয় করছে, যা দেশের বড় সম্পদ।
তৃতীয় ধাপ (২৫–৩৫ বছর): আর্থিক দায়িত্ব শুরু
এই বয়সে কর্মজীবনের স্থিতি আসে এবং পরিবার গঠনের চিন্তা শুরু হয়। প্রথম সন্তান, বাড়িভাড়া বা ফ্ল্যাট কেনা, জীবনবীমা এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের তরুণরা হোম লোন, গাড়ির লোন এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগও শুরু করে।
সিঙ্গাপুরে সরকারিভাবে তরুণ দম্পতিরা হাউজিং স্কিম থেকে ভর্তুকি পায়, ফলে স্বল্প বয়সেই ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সহজ শর্তে সরকারি-বেসরকারি হোম লোনের সুযোগ থাকলে এই বয়সে আর্থিক নিরাপত্তা অনেক বেড়ে যাবে।
চতুর্থ ধাপ (৩৫–৪৫ বছর): আর্থিক স্থিতির যুগ
এই সময়ে আয় বাড়ে, কিন্তু খরচও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় সন্তান আসে, সন্তানের স্কুলে ভর্তি, অ্যাপার্টমেন্ট বা গাড়ি কেনা, উচ্চতর ডিগ্রি বা বিদেশে পড়াশোনার জন্য সঞ্চয় তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
এ সময়েই বীমা, স্বাস্থ্যসেবা এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে খুচরা পুঁজিবাজারে ৭০ শতাংশ বিনিয়োগকারীর বয়স ৪৫ বছরের নিচে। সুতরাং পরিবারগুলো যদি সন্তানদের উচ্চশিক্ষা এবং নিজেদের বার্ধক্যের জন্য এই বয়সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তাহলে ভবিষ্যতের চাপ অনেকটাই কমবে।
যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ইতালি, পোল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে এই বয়সের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিটায়ারমেন্ট পেনশন চালু হয়। এ ছাড়া ইউরোপের কিছু কিছু দেশে স্থানীয়দের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাওয়া যায়, যা পরিবারগুলোর আর্থিক চাপ কমায়।
পঞ্চম ধাপ (৪৫–৫৫ বছর): ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিশেষ করে ক্যারিয়ারের শীর্ষে পৌঁছানোর পাশাপাশি এই বয়সে ঋণ পরিশোধ, সন্তানের উচ্চশিক্ষার খরচ এবং অবসর তহবিল গঠন করা জরুরি। স্বাস্থ্য পরীক্ষার নিয়মিত অভ্যাসও অপরিহার্য।
অস্ট্রেলিয়ায় ‘সুপারঅ্যানুয়েশন’ বাধ্যতামূলক, যেখানে কর্মজীবনের একটি অংশ সরাসরি অবসর তহবিলে জমা হয়। বাংলাদেশেও এমন বাধ্যতামূলক সঞ্চয় ব্যবস্থা চালু হলে এই বয়সে আর্থিক নিরাপত্তা বাড়বে।
ষষ্ঠ ধাপ (৫৫–৬৫ বছর): অবসরের প্রস্তুতি
অবসরের জন্য মানসিক ও আর্থিক প্রস্তুতি মূল লক্ষ্য। এ সময় প্যাসিভ ইনকাম যেমন ভাড়া, লভ্যাংশ এবং সঞ্চয় স্কিম তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া অবসর-পরবর্তী স্বাস্থ্যবীমা এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ অপরিহার্য।
জার্মানির পেনশন সিস্টেম তিন স্তরে সাজানো, যা নিশ্চিত করে যে অবসরের পরও মানুষ আর্থিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। বাংলাদেশেও জাতীয় পেনশন স্কিম আরও সম্প্রসারণ এবং বিশ্বস্তকরণ জরুরি।
সপ্তম ধাপ (৬৫ বছরের পর): প্রশান্তির অবসর
অবসর জীবনে শান্তি উপভোগ, সম্পদ সংরক্ষণ, উত্তরাধিকার নির্ধারণ এবং উইল বা ট্রাস্ট হালনাগাদ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাতি-নাতনিদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়ানো, সমাজসেবা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনাও প্রয়োজন।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে অবসরপ্রাপ্তরা সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং উত্তরাধিকার পরিকল্পনার নিশ্চয়তা পান। বাংলাদেশেও প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী করা উচিত।
পরিশেষে, জীবনের প্রতিটি ধাপে আর্থিক পরিকল্পনার ধরন আলাদা। বাংলাদেশে এখনো ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনা অনেকাংশে অবহেলিত। কিন্তু বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সচেতনভাবে পরিকল্পনা করলে সারা জীবন আর্থিক নিরাপত্তা এবং মানসিক শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।
সঠিক আর্থিক পরিকল্পনা কেবল ব্যক্তির জীবনই বদলাবে না; বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করবে।
লেখক পরিচি: এম এম মাহবুব হাসান ব্যাংকার, উন্নয়ন গবেষক ও লেখক ই-মেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন