

বাঙালির লোকসংগীত কেবল সুরের ঝংকার বা প্রেমের আর্তি নয়, এটি নদীবিধৌত এই ব-দ্বীপের মানুষের জীবন-দর্শন, আত্মিক জিজ্ঞাসা এবং অস্তিত্বের অমোঘ ছন্দ। এই লোকায়ত চেতনার দার্শনিক নির্যাস বহন করেই বিশ শতকের প্রথমার্ধে আবির্ভূত হয়েছিলেন শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ (১৯০১-১৯৫৯)। যার কণ্ঠে ছিল মাটির সহজাত ঔদার্য আর প্রান্তিক মানুষের অব্যক্ত বেদনাবোধ। কেরানির সামান্য জীবনযাপনের বিপরীতে ব্যক্তিগত বিনয় তার কাজের বিপুল প্রভাবের সঙ্গে এক শৈল্পিক বৈসাদৃশ্য তৈরি করে।
তিনি ছিলেন মাটির সুরে মানুষের অমরত্বের গান গাওয়া এক কালজয়ী শিল্পীসত্তা। ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর কুচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী তার শৈশবে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনসংগ্রামের গভীরতাকে আত্মস্থ করেছিলেন। তার পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন উকিল। তার কণ্ঠের অন্তর্নিহিত দরদ ও সহজাত আন্তরিকতা, তার জীবনসংগ্রাম এবং গ্রামীণ মানুষের কষ্টের গূঢ় মনস্তাত্ত্বিক প্রতিফলন— তাকে করেছিল অতুলনীয়।
১৯৩১ সালে যখন তিনি কলকাতায় পদার্পণ করেন, তখন তা ছিল বাঙালি সংগীতের ইতিহাসে এক নবজাগরণের সূত্রপাত। সেই সময়ে কলকাতা শহরে হিন্দু-মুসলিম সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ও দ্বন্দ্ব তীব্র ছিল। তিনি ছিলেন প্রথম মুসলিম গায়ক, যিনি তার আসল নাম ব্যবহার করে গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করে চিরাচরিত বৈষম্যের দেয়াল ভাঙেন।
জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে এবং পরে কৃষি দপ্তরে কেরানির চাকরি করেন। তার প্রথম রেকর্ড করা গান থেকে শুরু করে প্রায় সাত শতাধিক গানের বিশাল যাত্রা— এর মধ্যে প্রধানত লোকসংগীত এবং বিপুল সংখ্যক ইসলামী গান তাকে কিংবদন্তিতে পরিণত করে। সংগীত তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি লোকসুরের মৌলিকতাকে অক্ষুণ্ন রেখেও এতে উচ্চাঙ্গ সংগীতের সরল অলংকার যুক্ত করে লোকগানকে একটি নতুন শহুরে শৈলী দেন।
তার গায়কীর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল ভাওয়াইয়ার উপধারা ‘ক্ষীরোল চটকা’ গেয়ে খ্যাতি অর্জন করা এবং এর সঙ্গে দোতরা-এর মতো আঞ্চলিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারকে জনপ্রিয় করা। দোতরা ছিল সেতার বা এসরাজের মতো অভিজাত বাদ্যযন্ত্রের বিপরীতে প্রান্তিক বাংলার বাদ্যযন্ত্রের স্বকীয়তার প্রতীক। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী চারটি বাংলা চলচ্চিত্রে (বিষ্ণুমায়া, মহানিশা, একটি কথা এবং ঠিকাদার) অভিনয় ও প্লেব্যাকও করেছিলেন।
আব্বাসউদ্দীন লোকসংগীতের প্রতিটি ধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। তার কণ্ঠে অমর হয়ে থাকা ভাটিয়ালি গানগুলো মানব জীবনের অনিশ্চয়তা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। তার গভীর দর্শন প্রকাশিত হয়েছে যখন তিনি গেয়েছেন : ‘নদীর কূল নাই, কিনার নাই রে...’ কিংবা ‘মাঝির ঘরে বইয়া।’তার বিখ্যাত গান ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে’ ছিল একাধারে প্রেম ও সাংস্কৃতিক নৃতাত্ত্বিক দলিল, যেখানে দূর পথের পানে চেয়ে থাকা নারীর আর্তি বাংলার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তার আরও একটি অমর সৃষ্টি ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’— এই বিচ্ছেদী সুরটি মূলত মহাজনী শোষণ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সংবেদনশীল প্রেক্ষাপট তৈরিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল। মুর্শিদি ও মর্সিয়া গানে তার আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা এবং মরমীবাদী দর্শনও স্পষ্ট হয়ে উঠত। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মন্ত্রিত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। এই সময়েই তিনি শিল্পীদের রয়্যালটি এবং কপিরাইট নিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আইনি সংগ্রাম শুরু করেন।
আব্বাসউদ্দীন ছিলেন লোকসংগীতের একজন নিবেদিতপ্রাণ সংরক্ষকও, যিনি সংগ্রাহক কানাইলাল শীলের কাছে তার গানের উপাদানের জন্য কৃতজ্ঞ ছিলেন। আব্বাসউদ্দীনের উদ্যোগেই কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষায় প্রথম ইসলামি গান রচনা শুরু করেন। তাদের এই সৃষ্টির মাধ্যমে ধর্মীয় উদ্দীপনা ও বাঙালি সংস্কৃতি একীভূত হয়; যেমন, যখন তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, ‘মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। তার ইসলামি গানগুলোতে তিনি উর্দু কাওয়ালীর প্রভাবকে পরিহার করে বাংলার কীর্তন বা জারি-সুরের মতো নিজস্ব লোকসুর যুক্ত করেন। নজরুল ছাড়াও তিনি কবি জসীমউদ্দীন, আবদুল লতিফ এবং গোলাম মোস্তফার মতো গুণী গীতিকার-সুরকারদের সঙ্গে কাজ করেন। তার আত্মজীবনী ‘আমার শিল্পীজীবনের কথা’ গ্রন্থে তিনি লোকসংগীতের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, তা ছিল তার দূরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আব্বাসউদ্দীন আহমদ ঢাকায় সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কেবল লোকশিল্পী-তালিকাই তৈরি করেননি, তাদের নিবিড় প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের নীতির মধ্যেও বাংলার লোক-ঐতিহ্যের শক্তি ও গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি কেবল নিজ ভূখণ্ডেই নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও বাংলার লোকসংগীতকে তুলে ধরেন।
১৯৫৫ সালে ম্যানিলায়, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংগীত সম্মেলনগুলোতেও প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। তার এই অনন্য গায়নশৈলী এবং লোকসুরকে আধুনিক যন্ত্রে ব্যবহার করে ‘আধুনিক পল্লীগীতি’ নামে একটি নতুন সংগীত ধারার ভিত্তি স্থাপন করেন। তার এই ধারার উত্তরাধিকার বহনে শিল্পী আব্দুল আলিম তার শৈলীকে বহন করেন এবং তার পুত্র মোস্তফা জামান আব্বাসী লোকসংগীতকে তত্ত্বীয় কাঠামোয় বিশ্লেষণ করেন, অন্যদিকে কন্যা ফেরদৌসী রহমান এই লোকসুরকে আধুনিক গায়নশৈলীতে নিয়ে গেছেন।
আব্বাসউদ্দীন আহমদের জীবদ্দশায় তাকে প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি অনেকখানিই অধরা ছিল। ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তার জীবনাবসানের পর, শিল্পকলার প্রতি তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত করা হয়। তার সংগীত দ্বারা নির্মিত সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করে। তার কণ্ঠে বেজে ওঠা প্রতিটি সুর বাংলার জনমানসের অলিখিত ইতিহাসের শব্দায়ন। তার সংগীত কেবল একটি সময়ের দলিল নয়; এটি জাতীয় চেতনার অবিস্মরণীয় বীজকোষ, যা সময়কে অতিক্রম করে আজও মানবমুক্তির জয়গান গেয়ে চলেছে। এই সাংস্কৃতিক মুক্তি ছিল একইসঙ্গে ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে গান গাওয়ার অধিকার এবং গ্রামীণ লোকায়ত সুরকে শহরের অভিজাত বলয় থেকে মুক্ত করার এক শৈল্পিক বিজয়।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
মন্তব্য করুন