মাসখানেক লাপাত্তা থাকার পর চীনের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ (৫৭ বছর বয়সী) পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুইন গ্যাংকে অপসারণ সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। কী কারণে কুইনকে অপসারণ করা হলো এবং কেন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে কুইন যেসব বৈঠকে অংশ নিয়েছেন সেসব ছবি মুছে দেওয়া হলো- এসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে ঘটনাটি শুধু একজন মন্ত্রীর নিখোঁজ হওয়ার চেয়ে বড়।
চীনের অভিজাত রাজনীতির অনিশ্চয়তা আর অস্বচ্ছতা এর মূলে রয়েছে। শি জিনপিংয়ের লৌহমুষ্টিতে চীন আবদ্ধ আছে ধরা হলেও উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিবিদ এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীর ওপরও এ গণ্ডগোলের প্রভাব পড়েছে। বহুদিন ধরে চীনের পর্যবেক্ষকরা কমিউনিস্ট পার্টি এবং এর কার্য প্রক্রিয়া বোঝার জন্য একটি বিশ্লেষণী রূপরেখা তৈরি করতে চাইছেন। তবুও সিসিপির স্বচ্ছতার অভাব এই চেষ্টাকে অনেকাংশে স্তিমিত করেছে।
কুইন রহস্যের সর্বশেষ উদাহরণ।
শি তৃতীয়বারের মতো পার্টির নেতা এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ২০তম পার্টি কংগ্রেসের অনুমোদন তাকে পূর্বেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে আরও ক্ষমতাবান করে তুলেছে। তার প্রতি অনুগতদের পার্টি ও রাষ্ট্রের শীর্ষ অর্থাৎ পলিটব্যুরো, এর স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং স্টেট কাউন্সিলের বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন।
অনেক পর্যবেক্ষক এটা মনে করেন, শি ক্ষমতাকে যেভাবে একত্রীকরণ করেছেন তা স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এটা নির্দেশ করে যে- সিসিপির রাজনীতি একঘেয়ে কিন্তু বেশ স্থিতিশীল মডেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা এমন এক মডেল যেখানে ব্যক্তিগত সূত্র ব্যবহারের মাধ্যমে স্থায়ী নীতি বাস্তবায়িত করে বিজয়ীকে লাভবান করা হয়।
ধূমকেতুর মতো কুইনের রহস্যজনক অনুপস্থিতি এবং পতন শি জিনপিংয়ের একত্রীকরণের মডেলের উদ্দেশ্যকে ভুল প্রমাণ করেছে।
চলতি বছরের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে কুইন স্টেট কাউন্সিলরের পদ পাবেন বলে অনুমান করা হয়েছিল। এটি ক্যাবিনেট মিনিস্টারের চেয়েও বড় পদ। প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক প্রটোকল টিমের প্রধান থাকার সময় থেকেই শি ভালো করে কুইনকে চিনতেন। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে দূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন কুইন যা তার কর্মজীবনকে আরও বর্ণাঢ্য করেছে।
শি স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে কুইনকেই মনোনীত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ২০তম পার্টি কংগ্রেসে শি জিনপিং এর সরাসরি উত্তরসূরি না থাকায় এবং কুইনের বয়সের কারণে তার বড় সম্ভাবনা ছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পদ পাওয়ার পর কুইনের কার্যক্রম তার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কংগ্রেসের পর চীনের পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে চীন যে চাপে রয়েছে তা নিরসন করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে শির বৈঠকে তাকে বেশ ভালো রকমের সাহায্য করেছিলেন। ২০২৩ সালে রহস্যজনক বেলুন কাহিনির পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের স্থিতি কিছুটা দুর্বল হলেও কুইনের দল নিরসনে কাজ করে গেছেন। বেলুন কাহিনির পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের চীন সফর বাতিল হলেও তিনি বেইজিংয়ের কুইনের সঙ্গে ঠিকই দেখা করেছিলেন। জুনে তার নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে তিনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে দেখা করেন।
কুইন প্রথম দিকে আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতির চেহারা হিসেবে পরিচিত হলেও, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব রাখার কারণে সে ধারণা পরিবর্তিত হয়েছিল। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে একটি লেখায় তিনি এটাও বলেছেন যে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরও বিস্তার ঘটাবে এবং কখনো তা বন্ধ হবে না।
কুইন ক্ষমতায় আসার পর আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান জনসম্মুখ থেকে সরে গেছেন। এপ্রিলে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসালা ভন ডার বেইজিং ভ্রমণ করলে ইউরোপের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়।
কুইনের ধূমকেতুর মতো উত্থান এবং শির ভূরাজনৈতিক চাপ লঘু করার ভেতর সরাসরি একটি সম্পর্ক রয়েছে। এটি চীনাদের পড়ন্ত অর্থনীতির উন্নয়ন আরও এবং বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও তথ্যপ্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে জড়িত একটি বিষয়।
কুইন গ্যাংয়ের হঠাৎ নিখোঁজের ঘটনা চীন ও চীনের বাইরে বড় প্রভাব ফেলবে। এ ঘটনায় এটাই পরিষ্কার হয়েছে যে শির নেতৃত্বে পার্টির দলাদলি যে এখনো শেষ হয়নি এবং সম্ভবত এ কারণেই কুইনের পতন ঘটেছে। কুইনের পূর্বসূরি ৬৯ বছর বয়সী ওয়াং ই তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে পুনরায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলে তা বিব্রতকর হবে। এ ছাড়া এতে করে নীতিনির্ধারক সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচনে ব্যর্থতার ভয়ও প্রকাশ হয়। এমনিতেই চীনের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ছে এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে চীনারা বেশ কঠিন অবস্থানে রয়েছে। এর ভেতর নতুন করে ভুল কাউকে নির্বাচিত করলে তা চীনের রাজনৈতিক স্থিরতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়া নিয়ে আন্তঃদলীয় কোন্দল বাড়তে পারে।
যদিও এটা কারও অজানা নয়, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণে নিয়ে কুইনের চিন্তাভাবনার উলটো চিন্তা করতেন ওয়াং ই। এমনকি চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেক সহকর্মীও কুইনের এসব চিন্তাধারার বিরোধিতা করেছেন।
কুইনের ঘটনাটি চীনের রাজনীতির জীবিত বা মৃত ব্যবস্থার কথাই যেন বর্ণনা করে। যদি চীনা পররাষ্ট্রনীতি আবারও সেই আক্রমণাত্মক নেকড়ে যোদ্ধা পর্যায়ে চলে যায় তবে বিদেশি কর্মকর্তা তাদের বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিষয়ে নতুন করে ভাববেন। এতে চীনারা ভূরাজনৈতিকভাবে এবং সরবারহ ঘাটতির চরম ঝুঁকিতে পড়বে।
বিগত কয়েক মাসে কোভিডের সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার পর চীনারা বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে আবারও লাল গালিচা বিছানোতে মনোযোগী হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চীন থেকে তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছে। ২০২৩-এর মে মাসে টেসলার সিইও ইলন মাস্ক চীন ভ্রমণের সময় কুইন আশা দিয়েছিলেন যে এসব কোম্পানির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে বাণিজ্য সম্ভাবনা তৈরি হবে।
একটি চীনা প্রবাদ আছে, ‘মানুষ সরে গেলে চা জুড়িয়ে যায়।’
কুইনের চলে যাওয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা এবং আরও বড় অর্থে পুরো বিশ্ব আর জানবে না- তার কথা কেউ গোনায় ধরা হয় কিনা।
মূল লেখা : চেন গ্যাং Chen Gang, সহকারী পরিচালক, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর।
ভাষান্তর : সরকার জারিফ
মন্তব্য করুন