১৫ আগস্ট শুধুই একটি হত্যাযজ্ঞ বা সরকার উৎখাতের ঘটনা নয়। একটি শোকবার্ষিকীও নয়। প্রতিবছর কলঙ্কিত আগস্ট এলেই শোককে শক্তিতে পরিণত করার অঙ্গীকার শোনা যায়। বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের নিহতদের নিয়ে মাসজুড়ে নানা কর্মসূচিও চলে। আর মাসটির সমালোচনা তো আছেই। কিন্তু মাস বা সময় নির্দোষ। দায় মাসের নয়। দায়ী হায়েনারা, সর্বোপরি তাদের নেপথ্য কুশীলবদের। এ মাসটিতে তো বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী-ছায়াসঙ্গী শেখ ফজিলাতুন নেছা এবং তাদের বড় সন্তান শেখ কামালেরও জন্মদিন। আগস্ট এলে পলাতক অবশিষ্ট খুনিদের ধরে আনার চেষ্টা ও নেপথ্য কুশীলবদেরও ধরে আনার চেষ্টার খবরও শোনানো হয়। যা প্রকারান্তরে ১৫ আগস্টকে মৌসুমি বিষয়ে পরিণত করে দেওয়া। আগস্ট শেষে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাওয়ার পর বিষয়টিও মিলিয়ে যায়। অন্তত সামনের এক বছর এর আর কোনো ফলোআপ থাকে না। এ নিয়ে গবেষণার তাগিদও হারিয়ে যায়।
যাকে পাকিস্তানি দুঃশাসকরাও হত্যার সাহস দেখায়নি, তাকে কিছু বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা সপরিবারে হত্যা করল কোন শক্তির বলে? বিষয়টি কি এমন যে, চলতি পথে তুচ্ছ কোনো বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায় রাগের মাথায় মেরে ফেলা হয়েছে? অথবা দুয়েক দিনের পরিকল্পনায় কাণ্ড ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে? নিশ্চয়ই তা নয়। বঙ্গবন্ধু কাদের জন্য ক্ষতিকর ছিলেন, সশরীরে জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণদের বাইরে ষড়যন্ত্রকারী কারা, কে-কারা সুবিধাভোগী, হত্যাকাণ্ডে বাঙালি জাতি ও রাষ্ট্রের কী ক্ষতি হয়েছে, বিচাররহিতকরণে রাষ্ট্র ও মানবতার কী ক্ষতি হয়েছে—এসব বিষয়ে গবেষণার যথেষ্ট উপাদান এখনো বিদ্যমান। জাতির স্বার্থে ও ইতিহাসের দাবির আলোকে এসবের আইনি, সাংবিধানিক, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অধিকতর তথ্যানুসন্ধান এবং গবেষণা জরুরি।
১৫ আগস্ট দেশে-দেশে সংঘটিত আরও অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের মতো ফৌজদারি অপরাধ নয়। শুধুই কয়েকজন বিপদগামী উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তার দলবদ্ধ আস্ফালনও নয়। জল্লাদের ভূমিকা পালনকারী ফারুক-রশীদরাই সব নয়। নির্মোহ গবেষণা-বিশ্লেষণ না থাকায় হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপরের ষড়যন্ত্র শনাক্তের বিষয়টি এক প্রকার উহ্যই থেকে যাচ্ছে। এর একটা পরিপূর্ণ রিপোর্ট বা গবেষণা থেকে জাতি থাকছে অবিরাম বঞ্চিত। এটি কারও কারও জন্য সুযোগ। এ সুযোগের অসদ্ব্যবহার করে যাচ্ছেতাই বলার বা প্রচারের ঘটনা মাঝেমধ্যেই শুনতে হয়। দেখতেও হয়। ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ শীর্ষক আস্ফালনও হয়।
ওই হত্যাকাণ্ড মোটেই অরাজনৈতিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যহীন ছিল না। আবার কয়েক খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর মানেই বিচার শেষ হওয়ার মতো বিষয়ও নয়। অথচ দুঃখজনকভাবে ওই ট্র্যাজেডির অনেক কিছুই এখনো অস্পষ্ট। এ-সংক্রান্ত কার্যকর গবেষণা নেই বললেই চলে। যার জেরে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কোনোটাই অদ্যাবধি স্পষ্টভাবে উঠে আসেনি। দেশের প্রচলিত আইনে আর দশটা হত্যাকাণ্ডের ফৌজদারি বিচারের মতোই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডেরও একটি বিচার হয়েছে মাত্র। জঘন্য ওই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সাবেক সেনাসদস্যদের অঘটনের প্রায় ৩৫ বছর পর দণ্ড দেওয়া হলেও বেসামরিক কারও বিচার হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তার সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার হত্যাকারীদের বিচার না করার বিধান রেখে জারি করে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। দুই দশকেরও পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। চূড়ান্ত রায়ে তৎকালীন মধ্যম সারির ১২ সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এর সঙ্গে জড়িত বা বেনিফিশিয়ারি রাজনীতিকরা অধরা এবং অস্পষ্ট থেকে গেছেন। মামলায় সেনাসদস্যদের বাইরে যে কজনকে আসামি করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে মূল একজন খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং আরও দুজন তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চাষীর মৃত্যু হয়ে যাওয়ায় তাদের নাম আগেই মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
১৯৯৮ সালে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে নিম্ন আদালত থেকে রায় দেওয়া হলেও, পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দীর্ঘ সময় উচ্চ আদালতে আপিলের কার্যক্রম ঝুলে থাকে। পরে ২০০৯ সালে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে উচ্চ আদালত চূড়ান্ত রায় দেন। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। হত্যাকাণ্ডের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অবস্থা বিবেচনা করলে এর সঙ্গে বেসামরিক একটি অংশের সম্পর্ক বুঝতে অতি বোধ-বুদ্ধির দরকার পড়ে না। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির আরেক ট্র্যাজেডি হচ্ছে এ নিয়ে আজতক ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজনীতিকদের যোগসাজশের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা হয়নি। একে বটম লাইন ধরে কোনো তদন্তও হয়নি। রায়ে ষড়যন্ত্রের কথা বলা হলেও এর পেছনে কী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং রাজনীতিকরা কীভাবে এ ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন, তা মামলায়ও উঠে আসেনি। ১৫ আগস্টের আগে বঙ্গবন্ধুকে ক্রমেই অজনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা, হত্যাকাণ্ডের দিনক্ষণ বাছাই, সরাসরি বা সশরীরে জড়িতদের দায়মুক্তি, এত বড় হত্যাকাণ্ডের পুরস্কার হিসেবে কূটনৈতিক কোরে মামুলি চাকরি, তাদেরই আবার দেশে এনে খুচরা রাজনৈতিক দল খোলার ব্যবস্থা করার ঘটনা অবশ্যই গবেষণার উপাদান হতে পারে। বিশ্বের কোথাও আর এমন নজির আছে কি না, তালাশ করার বিষয়।
মেজর শরিফুল হক ডালিম রেডিও স্টেশন দখল করে বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরদিন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোও ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানান। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে হঠাৎ ইসলামী প্রজাতন্ত্র তৈরির ধারণা না টিকলেও ঘোষণাটি কি তাৎক্ষণিক বিকারপ্রসূত ছিল? এর তথ্য ও সূত্র খুঁজলে ইতিহাস তার উপাদান পেত। জাতির ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক হতো। এ নিয়ে গবেষণাসহ আরও তদন্ত ইতিহাসের দাবি হলেও সেদিকে গরজ বা উদ্যোগ দেখা যায় না। তাই বলে সময় চলে যায়নি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে হত্যাকাণ্ডের ফৌজদারি বিচারের ব্যবস্থা হলেও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের দিকটি কেন অজানা থাকবে?
ষড়যন্ত্রটির নেপথ্যে কারা ছিল—তা উদঘাটনে বিশদ গবেষণা ও তদন্তের দাবি রাখলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা বিষয়ে লিখতে গেলে অনেকাংশেই এ যাবৎ প্রকাশিত বিদেশি লেখকদের লেখা ও গোপন তথ্যের ওপরই নির্ভর করতে হয়। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য মোটেই সম্মানের নয়। হত্যাকারীদের তখন কোনো রাজনৈতিক চেতনা ছিল কি না, থাকলে তারা ক্ষমতার শরিক না হয়ে দেশ ছেড়ে পালাল কেন?—এ প্রশ্নের কূল-কিনারা আজতক খোঁজা হয়নি। তারা ভাড়ায় খাটা বা ‘হাইলি মোটিভেটেড’-এর শিকার কি না, সেই বিশ্লেষণও দেখা যায় না। ইতিহাসের মর্যাদার স্বার্থে এসব জিজ্ঞাসা পরিষ্কার হওয়া দরকার। নিজেদের সূর্যসন্তান, পঁচাত্তরের বীর, আগস্ট বিপ্লবের মহানায়ক ইত্যাদি দাবি করার পর লুকানো-পালানো-ক্ষমাভিক্ষার সূত্র মেলে না। একটি নির্মোহ কমিশন সেই রহস্য ও ষড়যন্ত্র উদঘাটনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, ভারতে মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী হত্যার পর এ ধরনের সত্য উদঘাটন মিশন শুরু করা হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন কেনেডি হত্যাকাণ্ডের সাত দিনের মধ্যে ১৯৬৩ সালের ২৯ নভেম্বর একটি কমিশন গঠন করেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে এ কমিশন ওয়ারেন কমিশন হিসেবে পরিচিত। ওয়ারেন কমিশন নামে পরিচিত কমিশনটি স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন দিয়েছিল। যা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, গোটা বিশ্বেরই সম্পদ। পরে প্রতিবেদনটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তা বিশ্ববাসীর জানতে পাঠাগারেও রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড মোটেই এক ব্যক্তি বা কোনো পরিবারের হত্যাকাণ্ড বিবেচনা করা সমীচীন নয়। নতুন করে কাউকে শাস্তি দেওয়া নয়, ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করা এবং প্রজাতন্ত্রের মালিক হিসেবে, কারা জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। বলাবাহুল্য, ফৌজদারি মামলা একটি চলমান প্রক্রিয়া। কারণ এটি সব ক্ষেত্রে শেষ হয় না।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যার তদন্তের কাজ এখনো ‘সম্পন্ন’ ঘোষণা দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ তদন্ত চলমান। আর তদন্ত মানে গবেষণা-বিশ্লেষণ। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠনে কোনো আইনি বা সাংবিধানিক বাধা থাকার কথা নয়। এটি খুব কঠিন কাজও নয়। কমিশনের ধরন এবং কার্যপ্রণালি নির্ধারণ আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ। পুরো ঘটনাটির হোতাদের সম্পর্কে জানা মানুষের অধিকারও। তথ্য অধিকার গোটা বিশ্বেই স্বীকৃত-সমাদৃত। তা গবেষণারও বিষয়। অন্তত বঙ্গবন্ধু কার জন্য হুমকি ছিলেন, কারা তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল, তার দ্বারা কার পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়েছিল—এসব জানতে বিদেশ থেকে কাউকে হায়ার করতে হয় না। তা না করায় এবং নিজস্বতায় পরিপূর্ণ গবেষণা না থাকায় এখনো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড শুধুই শোকগাথায় থেকে যাচ্ছে। সরকারের তরফে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং যোগসাজশের বিষয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের কথা আগস্ট এলে উচ্চারণ হয়। এ জন্য প্রয়োজনীয় আইনের খসড়া তৈরির কথাও শোনানো হয়েছে। নির্মোহ একটি গবেষণা হলে নিশ্চিত ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের অনেক অস্পষ্টতা দূর হবে, ইতিহাসও সমৃদ্ধ হবে।
মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন