মোহাম্মদ আনোয়ার
প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৫, ০৪:৪৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

দেশের জ্বালানি ভিত্তি সুদৃঢ় করতে অন্তর্বর্তী সরকারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত!

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প খাত ক্রমেই এলএনজি-নির্ভর হয়ে উঠছে। দেশে গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন হ্রাস পাওয়া এবং চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমদানি করা এলএনজি এখন জাতীয় অর্থনীতির প্রধান জ্বালানি উৎস। কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ হলো- সরবরাহ বাড়লেও তা রিগ্যাস করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনো পর্যাপ্ত নয়। এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদ্য গৃহীত সিদ্ধান্ত- দেশে স্থলভিত্তিক এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল স্থাপন, একে বিশ্লেষকরা ‘দীর্ঘদিনের কৌশলগত ঘাটতি পূরণের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখছেন।

বিদ্যমান ঘাটতি ও রিগ্যাসিং সংকট : বর্তমানে দেশে কেবল দুটি ভাসমান রিগ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল (FSRU) চালু রয়েছে- মহেশখালীতে অবস্থিত। এই টার্মিনাল দুটি সর্বোচ্চ ১১০০ এমএমসিএফডি রিগ্যাসিং করতে পারলেও ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ৮৫ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০২৬ সাল থেকে কাতার, ওমানসহ আরও তিনটি সরবরাহ চুক্তি কার্যকর হলে বছরে প্রায় ১০.৭৩ এমটিপিএ এলএনজি রিগ্যাসের প্রয়োজন হবে। ফলে বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়ে সেই বাড়তি সরবরাহ সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।

সাবেক পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জেনেন্দ্র নাথ সরকার বলেছেন, বর্তমান ব্যবস্থায় সরবরাহ বাড়লেও রিগ্যাস না করতে পারলে সেই গ্যাস অপচয় হবে এবং দেশের অর্থনীতি অকারণে ব্যয়ভার বহন করবে। বিশেষ করে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, সিরামিক, স্টিলসহ রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো এবং শহরাঞ্চলের আবাসন খাতে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হলে তার প্রভাব পড়বে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর।

LNG বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি : স্থলভিত্তিক টার্মিনালের পথে অগ্রসর বাংলাদেশ

জ্বালানি নিরাপত্তায় বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ স্থলভিত্তিক এলএনজি (Liquefied Natural Gas) রিগ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সম্ভাব্য স্থান হিসেবে বিবেচনায় রয়েছে মহেশখালী, মাতারবাড়ি, পায়রা এবং মোংলা উপকূলীয় এলাকা।

প্রধান উপদেষ্টা পরিষদের প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত বৃহস্পতিবার কাতারের দোহায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেছেন, বিভিন্ন উদ্যোক্তা অভিযোগ করেছেন, গ্যাসের ঘাটতির কারণে তারা কারখানা স্থাপন করতে পারছেন না। এ অবস্থায় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব একটি স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে, যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্যাস আমদানি ও সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।

বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে শিল্পখাতের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রেও এটি একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করবে।

প্রস্তাবিত টার্মিনালের মূল বৈশিষ্ট্য হবে: • রিগ্যাসিং সক্ষমতা: প্রাথমিকভাবে ৭.৫ এমটিপিএ • পরিকাঠামো: স্টোরেজ ইউনিট, পাইপলাইন সংযোগ, গভীর জেটি • সম্ভাব্য অর্থায়ন: ADB, JICA, এবং IFC সহ আন্তর্জাতিক সহযোগীদের অংশগ্রহণে • সম্ভাব্য ব্যয়: ১.৫ বিলিয়ন ডলার

এটি বাস্তবায়ন হলে দেশে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল ও সাশ্রয়ী জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি এই অবকাঠামো হবে জ্বালানি নিরাপত্তার কৌশলগত ভিত্তি।

FSRU না স্থলভিত্তিক টার্মিনাল: কোন পথে বাংলাদেশ? FSRU (Floating Storage Regasification Unit) • দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য (১২–১৮ মাস) • তুলনামূলকভাবে কম খরচে • প্রয়োজন অনুযায়ী সরানো সম্ভব

স্থলভিত্তিক টার্মিনাল • দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও স্থিতিশীল • উচ্চ রিগ্যাসিং ক্ষমতা • প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিরাপদ • বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের (ADB, JICA, Sovereign Funds) আগ্রহ বেশি

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হবে হাইব্রিড মডেল—স্বল্পমেয়াদে FSRU এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থলভিত্তিক টার্মিনাল স্থাপন। এর ফলে তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে, আবার দীর্ঘমেয়াদে অবকাঠামোগত সক্ষমতাও গড়ে উঠবে।

রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ নির্দেশনা:

যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ স্বল্পকালীন, তথাপি এ ধরনের সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থে অপরিহার্য। বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য ধারাবাহিক নীতিমালা, সার্বভৌম গ্যারান্টি এবং অফটেকার চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হলে আগামী নির্বাচিত সরকারকেও একই নীতির অনুসরণ করতে হবে।

পরিশেষে, জ্বালানি নিরাপত্তা শুধুই একটি প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক বিষয় নয়—এটি একটি কৌশলগত ও জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু। এলএনজি সরবরাহ বাড়লেও, রিগ্যাসিং ঘাটতি পূরণ না হলে দেশের শিল্প, বিদ্যুৎ ও জনগণের জীবনযাত্রা চরমভাবে প্রভাবিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জ্বালানি ভিত্তি সুদৃঢ় করার প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে—যদি তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়।

মোহাম্মদ আনোয়ার: সাংবাদিক ও জ্বালানি বিশ্লেষক, দুবাই প্রতিনিধি, দৈনিক কালবেলা

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হেফাজতে ইসলামকে আইনি নোটিশ দিলেন এনসিপির তিন নেত্রীসহ ৬ নারী

চট্টগ্রামে বিরল প্রজাতির রাজ ধনেশের বাচ্চা উদ্ধার

হিথ্রো বিমানবন্দরে খালেদা জিয়া

স্মার্ট টিভির বদলে টাচস্ক্রিন ডিসপ্লে পাবে শিক্ষার্থীরা 

বন্ধ হলো একসময়ের জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম স্কাইপি

সন্ধ্যার আগে দরজা-জানালা বন্ধ রাখার আহ্বান ডিএসসিসি প্রশাসকের

রাতের আঁধারে ৫২০টি পেয়ারা গাছ কেটে দিল দুর্বৃত্তরা

বেইলি রোডে ক্যাপিটাল সিরাজ শপিং সেন্টারে আগুন, উদ্ধার ৩

আইসিসির এপ্রিল সেরার দৌড়ে মিরাজ

গুলিবিদ্ধ ভারতীয় চোরাকারবারি আটক

১০

জাল স্বাক্ষরে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মনোনয়ন, ছাত্রদল নেতা গ্রেপ্তার

১১

সংকটে জর্জরিত পাকিস্তান, ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ১৯

১২

হাতের টানেই উঠে যাচ্ছে সড়কের কার্পেটিং

১৩

ভারতীয় প্রতিরক্ষা খাতের গোপন সব তথ্য পাকিস্তানিদের দখলে!

১৪

দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া, ডিএমপির বিশেষ নির্দেশনা

১৫

প্রশ্ন করলে সরকার আরও বেশি কাজ করবে : তথ্য উপদেষ্টা

১৬

জিএমআইটি কার্যালয় পরিদর্শনে চসিক মেয়র

১৭

বাংলাদেশি শিল্পীদের ‘ঘাড়ধাক্কা’ দিতে চাইলেন ভারতীয় উপস্থাপিকা

১৮

বর্ণাঢ্য আয়োজনে সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসের উদ্বোধন

১৯

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু

২০
X