রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২
এম এম মাহবুব হাসান
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

আধুনিক জীবনে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কৌশল

এম এম মাহবুব হাসান। ছবি : সৌজন্যে
এম এম মাহবুব হাসান। ছবি : সৌজন্যে

মানুষ একটি সামাজিক জীব—এই বাক্যটি আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। তবে এই কথাটির গভীরতা অনুধাবন করা সহজ নয়। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা। মানুষের সমাজে সম্পর্ক ছাড়া যেমন বাঁচা যায় না, তেমনি সম্পর্ক নিয়েও সব সময় শান্তিতে থাকা সহজ নয়। এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার মধ্যেই প্রতিনিয়ত গড়ে ওঠে, গুঁড়িয়ে যায় কিংবা টিকে থাকে আমাদের পরিবার, বন্ধুত্ব ও পেশাগত সংযোগগুলো।

আধুনিক জীবনে সম্পর্কের ধরন বদলেছে। আগে সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ত্যাগ, দায়িত্ব ও আন্তরিকতা—আজ সেখানে স্বার্থ, প্রতিযোগিতা, হিংসা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা প্রবলভাবে কাজ করে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ভালো সম্পর্ক আর সম্ভব নয়। বরং বর্তমান বাস্তবতায় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন নতুন কিছু কৌশল, মানসিক পরিণতিবোধ এবং সচেতন প্রয়াস।

এই প্রবন্ধে আমরা সেই বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ এবং সম্পর্ক রক্ষার জন্য বাস্তবসম্মত কৌশলগুলো নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

সম্পর্কের বাস্তবতা: স্বার্থ ও সংবেদনশীলতার সংঘাত

সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন—“প্রত্যেক সম্পর্কের গভীরে একধরনের স্বার্থ কাজ করে।” এই ‘স্বার্থ’ শব্দটি অনেকেই নেতিবাচকভাবে দেখেন, তবে এর তাৎপর্য সব সময় নেতিবাচক নয়। মানুষ নিরাপত্তা, ভালোবাসা, সহানুভূতি, গ্রহণযোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা কিংবা মানসিক প্রশান্তির আশায় সম্পর্ক গড়ে তোলে। এগুলোও এক ধরনের কোমল ও মানবিক স্বার্থ।

কিন্তু যখন এই স্বার্থ একতরফা হয়ে যায় বা পারস্পরিক সম্মানবোধ হারিয়ে ফেলে, তখনই সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়ে। তখন তা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা কিংবা নিয়ন্ত্রণের এক যুদ্ধক্ষেত্র।

উদাহরণস্বরূপ, পরিবারের ভিতরে ভাইবোনের মধ্যে সম্পত্তি কিংবা পরিবারের দায়িত্ববণ্টন নিয়ে বিভেদ দেখা যায়। বন্ধুদের মধ্যে একজনের সাফল্য অন্যজনের মনে হীনম্মন্যতা বা ঈর্ষার জন্ম দেয়। কর্মক্ষেত্রে একজনের পদোন্নতি অন্যজনের মনে অন্যায়বোধ তৈরি করে—যা দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ককেও দূরে ঠেলে দিতে পারে।

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জসমূহ

১. অতিরিক্ত প্রত্যাশা ও নিরাশা

আমরা অনেক সময় নিকটজনদের প্রতি এমন সব প্রত্যাশা পোষণ করি, যা হয়তো তারা পূরণ করতে সক্ষম নয় কিংবা তাদের পক্ষে বাস্তবসম্মত নয়। যেমন—আমরা চাই, কাছের মানুষটি সব সময় আমাদের মনের কথা বুঝবে, সঠিক সময়ে পাশে থাকবে কিংবা আমাদের মতো ভাববে। কিন্তু তা না হলে আমরা হতাশ হয়ে যাই, রাগ করি বা অভিযোগে মন ভরে যায়। এই হতাশা ধীরে ধীরে সম্পর্ককে ভাঙনের দিকে ঠেলে দেয়।

২. নিজস্বতা না বোঝা ও না মানা

প্রত্যেক মানুষের চিন্তা, পছন্দ, জীবনদর্শন, অনুভূতির গভীরতা আলাদা। কিন্তু আমরা প্রায়ই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। এর ফলে সম্পর্ক হয়ে পড়ে একমুখী ও চাপসৃষ্টিকারী। মানুষ তখন নিজের নিরাপত্তার জন্য দূরত্ব তৈরি করে।

৩. যোগাযোগের অভাব

অসংলগ্ন যোগাযোগ, দীর্ঘ সময় যোগাযোগহীনতা, কিংবা মনের কথা খোলাখুলি না বলার অভ্যাস—সবকিছু মিলে অনেক সম্পর্কেই দূরত্ব তৈরি হয়। ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে। আধুনিক জীবনে প্রযুক্তির সঙ্গে যে মানুষ যত বেশি যুক্ত, বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলো থেকে সে ততই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

৪. অহংবোধ ও ক্ষমা না করার মানসিকতা

ক্ষমা চাইতে বা ক্ষমা করতে পারা একটি সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি। কিন্তু অনেকে এই সহজ কাজটিই করতে পারেন না, কারণ তারা মনে করেন ক্ষমা করলে নিজেকে ছোট প্রমাণ করতে হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন—‘আমি কেন প্রথমে ক্ষমা চাইব?’ এই অহংবোধের কারণে অনেক ভালো সম্পর্কেও ফাটল ধরে। ধীরে ধীরে সেই ফাটল দূরত্বে রূপ নেয়, যা আর সহজে জোড়া লাগে না।

সম্পর্ক রক্ষার কিছু বাস্তব কৌশল

১. আত্মজ্ঞান ও সংবেদনশীলতা বাড়ানো

সুসম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো নিজেকে জানা ও অন্যের অবস্থান বুঝতে শেখা। নিজের আবেগ, রাগ বা হতাশা কীভাবে সম্পর্ককে প্রভাবিত করে, তা বুঝতে না পারলে আমরা সম্পর্কের ক্ষতি নিজের হাতেই করে ফেলি। সংবেদনশীলতা মানে নিজে কষ্ট পেয়ে কাঁদা নয়, বরং অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারার ক্ষমতা অর্জন।

২. খোলামেলা ও সম্মানজনক যোগাযোগ

কিছু একটা বলা দরকার, তবে কীভাবে এবং কখন বলা হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। সম্পর্কের যত ঝামেলা, অধিকাংশই মিটে যেতে পারে যদি উভয়পক্ষ খোলামেলা, আন্তরিক এবং সম্মানজনকভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। এটি একটি নিয়মিত অভ্যাস হিসেবে গড়ে তুললে অনেক দূরত্বই কমে আসে।

৩. প্রশংসা ও স্বীকৃতি প্রদান

কোনো মানুষই চায় না তার চেষ্টা, কষ্ট বা সাফল্য অবমূল্যায়ন করা হোক। যদি আপনি চান কেউ আপনাকে সম্মান করুক, তাহলে প্রথমেই তাকেই সম্মান দিন। একজন সহকর্মীর সাফল্য দেখে ঈর্ষা না করে তাকে সাধুবাদ বা অনুপ্রেরণা দিন—এতে সম্পর্কও টিকে থাকবে এবং আপনার নিজের মনও হবে উদার ও প্রসারিত।

৪. ব্যক্তিগত সীমা মেনে চলা

প্রতিটি মানুষ একটি ব্যক্তিগত পরিসরের অধিকার রাখে—যাকে ইংরেজিতে বলা হয় “personal boundaries”। এটি হতে পারে তার একান্ত সময়, মানসিক অবস্থা, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের প্রতি সংবেদনশীলতা। সেই সীমারেখা অতিক্রম করলে তার অনুভূতিতে আঘাত লাগে, যা পরবর্তী সময়ে সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে।

৫. হিংসা নয়, প্রেরণা নেওয়া

পরিচিত কারও অগ্রগতি বা সাফল্যে ঈর্ষা অনুভব হলে নিজেকে প্রশ্ন করুন—“সে কীভাবে এটা করল?” এবং “আমি কীভাবে নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পারি?” এভাবে হিংসার জায়গা দখল করে নেয় শেখার মনোভাব, যা সম্পর্ককে বিষাক্ত না করে বরং আরো পুষ্টি জোগায়।

৬. দ্বন্দ্বে পরিপক্বতা দেখানো

সম্পর্কে দ্বন্দ্ব থাকবেই—তবে সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে সেটাই মুখ্য। আবেগে বিস্ফোরণ ঘটানো নয়, বরং যুক্তিভিত্তিক সমাধান খোঁজা উচিত। অনেক সময় একটু নীরবতা, একটু সময়, বা স্থানচ্যুতি—এই ছোট ছোট পন্থাই সম্পর্ককে ভেঙে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারে।

৭. মানসিক সুস্থতায় যত্নশীল থাকা

একজন মানসিকভাবে অস্থির মানুষ কোনো সম্পর্কেই সুস্থ থাকতে পারেন না। তাই নিজের ভেতরের ক্লান্তি, উদ্বেগ ও হতাশাকে চিহ্নিত করে সময়মতো আত্মসচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং নেওয়া কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করাও সহায়ক হতে পারে।

সম্পর্ক উন্নয়নে পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত প্রয়োগিক কিছু টিপস:

পারিবারিক জীবন

  • একসঙ্গে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা
  • নিয়মিত পারিবারিক বৈঠক
  • পারস্পরিক দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া
  • বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ছোটদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন

সামাজিক জীবন

  • গুজব বা পরচর্চা থেকে বিরত থাকা
  • বন্ধুদের সাফল্যে খুশি হওয়া
  • সময়মতো শুভেচ্ছা জানানো
  • কারো বিপদে সাধ্যমত পাশে দাঁড়ানো
  • সহানুভূতির দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা

পেশাগত জীবন

  • অফিস রাজনীতি এড়িয়ে চলা
  • সহকর্মীদের সঙ্গে সহযোগিতা ও শ্রদ্ধার আচরণ
  • সময়মতো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া
  • নেতৃত্বে থাকলে দমন নয়, উৎসাহ প্রদান করা

সম্পর্ক মানেই নিখুঁত বোঝাপড়া নয়, বরং বোঝার চেষ্টা—এটাই এর সৌন্দর্য। জীবনের প্রতিটি স্তরে সম্পর্কই আমাদের আশ্রয়, শান্তি এবং আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। তবে তা টিকিয়ে রাখার জন্য চাই যত্ন, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংবেদনশীলতা ও দায়িত্বশীলতা। আমাদের পারিপার্শ্বিক জীবনে স্বার্থ থাকবেই, তবে তা যদি ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবিক হয়, তাহলে সম্পর্ক ভাঙে না—বরং সময়ের সঙ্গে আরও গভীর ও দৃঢ় হয়ে ওঠে।

লেখক : ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পুরোনো খেলায় নতুন প্লেয়ার হতে আসিনি, খেলার নিয়ম বদলাতে এসেছি: নাহিদ ইসলাম

ক্যান্সার আক্রান্ত জিসানের চিকিৎসার খোঁজ নিলেন তারেক রহমান

সিরিয়ার নতুন জাতীয় প্রতীক ‘সোনালী ঈগল’, অর্থ কী ও কেন?

‘বিআইটি মডেল’ বাস্তবায়ন দাবিতে উত্তাল ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ

প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক উৎসবমুখর নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় বিএনপি : প্রিন্স

তপশিল ঘোষণার পর জোট বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে : ফারুক

কুমিল্লায় ৩ খুনের নেতৃত্বে ছিলেন চেয়ারম্যান-মেম্বার

চালের দাম নিয়ে সুখবর দিলেন খাদ্য উপদেষ্টা

আন্তর্জাতিক ইসলামি সংগঠনের প্রতিনিধির সঙ্গে ছাত্রশিবিরের সভা

প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন : ধর্ম উপদেষ্টা

১০

বিচার ও সংস্কারকে নির্বাচনের মুখোমুখি না করার আহ্বান সাকির

১১

বিএনপির সদস্য সংগ্রহ অনুষ্ঠানে হামলা

১২

আবুধাবিতে সাড়ে ৮৩ কোটি টাকার লটারি জিতলেন প্রবাসী বাংলাদেশি

১৩

ব্লাকমেইল করে সাংবাদিকের কাছে চাঁদা দাবি

১৪

বিমানের ডানা থেকে লাফ দিয়ে আহত ১৮

১৫

ইবিতে মাস্টার্সে পুনঃভর্তি / ছাত্রদল নেতাদের বিশেষ বিবেচনা, অন্যদের ক্ষেত্রে বঞ্চনা!

১৬

তানভীরের ফাইফারে সিরিজে সমতায় ফিরল টাইগাররা

১৭

প্রজাতন্ত্র নির্মাণে নতুন রাজনৈতিক ইশতেহার প্রয়োজন: জেএসডি 

১৮

চসিক মেয়রের সঙ্গে কানাডার ফেডারেল এমপির বৈঠক

১৯

যে কারণে জোতার শেষকৃত্যে ছিলেন না রোনালদো

২০
X