‘বহুদেশিক পরিবেশগত ন্যায়বিচার’ বা ‘Transnational Environmental Justice’ ধারণাটি প্রফেসর ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের। কেনিয়ার নাগরিক প্রফেসর ওয়াঙ্গারি মাথাই (Wangari Muta Maathai)’দ্য গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট’ নামের পরিবেশ সুরক্ষায় যুগান্তকারি একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। কেনিয়াতে তাঁর সংগঠন ‘দ্য গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট’ চলতি শতকের শুরুতে ৩ কোটি গাছ লাগিয়ে সারাবিশ্বকে আলোড়িত করেছিল। মাথাইয়ের নেতৃত্বে গাছ লাগানোর এই মহান কর্মযজ্ঞের ফলে কেনিয়াতেই ৩০ লাখ নারীর আত্ম ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়েছিল। প্রফেসর ওয়াঙ্গারি মাথাই ২০০৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন এবং তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নোবেলজয়ী নারী। ২০১১ সালে তিনি প্রয়াত হন। তবে পরিবেশ রক্ষায় ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের ধারণা-চিন্তা-কর্ম-আন্দোলন উৎসাহিত করেছে বিশ্বময় অনেক দেশকে। তন্মধ্যে ভারত ও চীন নিজ নিজ দেশে সবুজ বাড়ানো বা গাছ লাগানোতে উল্লেখযোগ্য কাজ করে যাচ্ছে।
ভারত ২০১৭ সনে নর্মদা নদীর দীর্ঘ অববাহিকায় একদিনে মাত্র ১২ ঘণ্টায় ৬ কোটি ৬০ লাখ গাছ লাগিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ লাখ হেক্টর জমি বনায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ভারত। নিজ দেশে সবুজ বৃদ্ধিতে ভারতের এ কার্যক্রম দৃশ্যত দায়ীত্বশীলতার পরিচয় বহন করে।
চীনেরও পরিবেশ রক্ষায় এ ধরনের অনেক প্রকল্প রয়েছে। তন্মধ্যে একটি উদাহরণ : গুয়াংজি প্রদেশের লিউঝুক শহরকে ‘বনের শহর’ বানাচ্ছে চীন; ৩০ হাজার বাসিন্দার শহরটিতে ৪০ হাজার গাছ লাগানো হচ্ছে সেখানে। চীনের বৃক্ষরোপণের এসকল উদ্যোগ নিজ দেশে সবুজায়ন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।
ওয়াঙ্গারি মাথাই তার ভূমিকা দ্বারা ‘Transnational Environmental Justice’ বা ‘বহুদেশিক পরিবেশ সুবিচার’-এর আদর্শ ও কর্ম ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সারা দুনিয়ায়। পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষায় তার মতো বলিষ্ঠ, প্রজ্ঞাময়, পরিণত ও ঋদ্ধ চিন্তায় সমৃদ্ধ আদর্শিক মানুষ বিরল। জলবায়ু পরিবর্তনের আজকের বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের ধারণা খুবই প্রাসঙ্গিক। পরিবেশ রক্ষায় বহুদেশিক বা আন্তঃদেশীয় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং এক দেশ অন্য দেশের প্রতি দায়ীত্বশীল আচরণ করা, আন্তর্জাতিক কনভেনশনের বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রফেসর মাথাইয়ের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানিয়ে এই ‘বহুদেশিক পরিবেশগত ন্যায়বিচার’-এর ধারণায় অভিন্ন নদীসংক্রান্ত পানি সমস্যার সমাধানের বিষয় পর্যালোচনা করা যায় এবং দেখা যায়—এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পানি প্রাপ্যতার ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পানিসম্পদ সর্বজনীন বিষয়। নদীর প্রবাহ উৎসগতভাবে প্রাকৃতিক। তবে বৈশ্বিকভাবেই একাধিক দেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর প্রবাহ রয়েছে এবং এর ফলে নদীর পানির প্রাপ্যতার সর্বজনীনতা নিশ্চিতকরণে সমস্যাও আছে। এই সমস্যার ওপর গুরুত্বারোপ করে ১৯৬৬ সালে হেলসিংকি সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশন গৃহীত হয়। হেলসিংকির গৃহীত নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনায় নেবে।
১৯৭১ সনের ২ ফেব্রুয়ারি ইরানের রামসারের কনভেনশনেও জলাভূমিসংক্রান্ত অনুরূপ সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল। পরে ১৯৯৭ সনের ২ মে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন’ ১০৬ সদস্যরাষ্ট্রের ভোটে গৃহীত হয়। যা ২০১৪ সাল ভিয়েতনামের ভোটের মাধ্যমে ৩৫ ভোটে পূর্ণতা পেয়ে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। এটিকে বলা হয়ে থাকে, ‘ জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নদীধারা সনদ’। জাতিসংঘের প্রণীত এই আইন, সনদ বা জলপ্রবাহ কনভেনশন অনুযায়ী, ‘নদীকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না, যাতে অন্যদেশ মারাত্মক ক্ষতি বা বিপদের মধ্যে পড়ে। একাধিক দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অভিন্ন নদীর ব্যবহার পারস্পরিক স্বার্থ, সহযোগিতা সম্পর্কিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। একের অধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর পানি কোনো দেশই অন্য দেশের অনুমতি ছাড়া একতরফাভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। দেশগুলো ন্যায়সঙ্গত, যুক্তিসঙ্গতভাবে নিজ নিজ দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অংশের পানি ব্যবহার করতে পারবে, তবে অন্য দেশের পানিপ্রবাহে যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে সেটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।’ কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর কাছে জাতিসংঘের এই কনভেনশন, আইন, সনদ উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
তিব্বতের ব্রহ্মপুত্রে সর্ববৃহৎ ‘জঙ্গমু’ বাঁধ-জলাধার-জলবিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়ে এবং হুবেই প্রদেশে ‘থ্রি জর্জেস’ বাঁধ ও বৃহত্তম বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে চীন ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর তথা অবাধ পানি প্রবাহের ন্যায্যতার ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত স্বীকৃত ৫৪টি আন্তসীমান্ত নদীর মধ্যে বাংলাদেশে ৫৩টি নদীর পানি আসে ভারত থেকে। গঙ্গায় ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের ২০টি নদী হারিয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে অন্য নদীগুলোতে শুষ্কমৌসুমে জলপ্রবাহ থাকে না। বর্ষায় হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত। ফারাক্কা অববাহিকার বাংলাদেশের বাকীসব নদীসমূহের পরিস্থিতিও একই।
ফিরে যাই, নোবেলজয়ী পরিবেশকর্মী ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের ‘পরিবেশগত ন্যায়বিচার’ এর ধারণায়।
পরিবেশগত এই ন্যায়বিচার তিস্তা, ফারাক্কাসহ অন্যসকল নদীর পানি প্রবাহের ক্ষেত্রে ভারতের কাছে আমাদের প্রাপ্য এবং এর প্রতি সংশ্লিষ্টরা কিছুটা হলেও দায়ীত্বশীল হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীসংক্রান্ত সমস্যাগুলো অচিরেই সমাধান হওয়া সম্ভব এবং এগুলো সমাধান হলে প্রফেসর মাথাইয়ের আন্দোলন-আদর্শ ও জাতিসংঘ সনদ বা আইনের কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা পাবে।
মোতাহার হোসেন চৌধুরী : লেখক ও গবেষক
মন্তব্য করুন