মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তার বেইজিং সফর শেষ করেছেন। এ সফর দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে কিছুটা আশা জাগালেও বাস্তবে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব নিরসনে কিছুই করতে পারেনি। উভয় পক্ষের মধ্যে জনশক্তি আদান-প্রদান জোরদার করতে সম্মত হওয়া এবং আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থেকেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে তাইওয়ান প্রণালিতে দুই পরাশক্তির যুদ্ধজাহাজ এবং দক্ষিণ চীন সাগরের ওপরে বিমানের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মধ্যে দু’পক্ষের সামরিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপনে ব্যর্থতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এ ছাড়া এই সফরে কিউবাকে ঘিরে চীনা নজরদারি ও সামরিক কার্যকলাপ সম্পর্কে কোনো আলোচনাই করা হয়নি। অথচ এ ঘটনা শীতল যুদ্ধের সময়কালের সবচেয়ে ভীতিকর মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটি, যা ১৯৬২ সালের কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের ঘটনাগুলোর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনাজনিত সংঘর্ষের ঝুঁকি অনেক বেশি।
দুটি দেশের মধ্যে অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলোর সমাধান ব্যক্তিগত কূটনীতির ওপর অনেক বেশি নির্ভর করছে। মার্কিন-চীন সম্পর্কের প্রাথমিক পর্যায়েও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক চীন সফর ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোনঠাসা করার লক্ষ্যে একটি কৌশলগত চাল।
স্নায়ুযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে এই ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এখানে প্রথম আসে রিচার্ড নিক্সন এবং মাও সেতুংয়ের নাম। এরপর হেনরি কিসিঞ্জার এবং ঝো এনলাইর মধ্যে সুসম্পর্ক মার্কিন-চীন সম্পর্কের ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায়। কিন্তু সেই দিনগুলো অতীত হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কূটনীতি তার উপযোগিতা অতিক্রম করেছে।
মার্কিন-চীন সম্পর্কের গতিবিধি এ যুগে রাজনৈতিকভাবে সীমাবদ্ধ নেতাদের হাতে এসে পড়ায় দুই পরাশক্তির মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনো নেতাকেই নমনীয় হিসেবে দেখা যায় না। তাই দ্বন্দ্ব মীমাংসা এ যুগে বাহ্যিক সম্পর্কের উপরেই বেশি নির্ভর করে।
উদাহরণস্বরূপ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ৩৫ মিনিটের সংক্ষিপ্ত বৈঠকে টেবিলের মাথায় বসার দিকে বেশি জোর দিয়েছিলেন। শি জিনপিং আমেরিকার সিনিয়র কূটনীতিককে অধীনস্থ একটি দৃশ্যে ফেলেছিলেন এবং যত তাড়াতাড়ি ব্লিঙ্কেন চীন ত্যাগ করেছিলেন তত তাড়াতাড়িই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনা নেতাকে স্বৈরশাসক হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। যা শত বছরের অবমাননার বেদনাদায়ক স্মৃতিতে ডুবে থাকা একটি দেশের সংবেদনশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
এ ধরনের পন্থা এখন আর কাজ করে না। কারণ বৈশ্বিক কূটনীতি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে থেকে সরে এসেছে। আমেরিকার দিক থেকে বদ্ধমূল চীনবিরোধী মনোভাবের ফলে বেইজিংয়ে পা রাখার অনেক আগে থেকেই ব্লিঙ্কেনের হাত-পা বাঁধা ছিল।
এটি ব্লিঙ্কেনকে কয়েকটি বিকল্প দিয়ে রেখেছিল। আর চীনের এ ধরনের চরম দৃষ্টিভঙ্গি সৃজনশীল মার্কিন কূটনীতিকে অকেজো করে দেয়।
একদলীয় ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও চীনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সমান গুরুত্বপূর্ণ। শি জিনপিংয়ের ক্ষমতার বৈধতা তার চীন স্বপ্নের ওপর নির্ভর করে। যে স্বপ্ন চীনা জাতির মহান পুনর্জীবনের কথা বলে। তবুও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছাড়াই শি জিনপিং সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার এবং জনগণ ও দলীয় ক্ষোভের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
চীনের বর্তমান প্রবৃদ্ধি ঘাটতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। যদিও প্রত্যাশিত ব্যাপক উৎপাদন অর্থনীতিতে স্বল্প -মেয়াদি চাপ কমাতে পারে, তবে জনসংখ্যা এবং উৎপাদনশীলতার সমীকরণ দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার জন্য অনেক বেশি অনিশ্চিত। চীনের রাজনীতি দেশটির ক্রমবর্ধমার ‘পুনরুজ্জীবন ঘাটতি’ দ্বারা অনেকটাই সীমাবদ্ধ।
ভঙ্গুর অহংকার কেবল সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এই পরিস্থিতিতে বাইডেনের ‘স্বৈরাচার বনাম গণতন্ত্র’ কাঠামো, শি জিনপিংকে স্বৈরশাসক বলা বা শি জিনপিংয়ের চেয়ার পজিশনিং... দ্বন্দ্ব নিরসনে এগুলো কাজ করবে না বরং তা দ্বন্দ্বকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
অবিলম্বে একটি নতুন পন্থা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। চিন্তাগুলো আরও প্রাতিষ্ঠানিক মডেলে স্থানান্তরিত হলে কেবল রাজনৈতিকভাবে সীমাবদ্ধ নেতাদের হাত থেকে দ্বন্দ্বের সমাধান হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে সমস্যা সমাধানে পারস্পরিক কৌশলের ওপর আরও মনোনিবেশ করতে হবে।
‘মার্কিন-চীন কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সংলাপ’ এবং ‘বাণিজ্য ও বাণিজ্যের যৌথ কমিশন’ উভয় প্রচেষ্টাই বর্তমান দ্বন্দ্ব প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এসব উদ্যোগকে পুনরুজ্জীবিত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর কারণ হলো, তারা সম্পর্ক পরিচালনার জন্য একটি স্থায়ী, শক্তিশালী কাঠামো প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন।
অনেকের মতো আমিও দুটি শক্তিশালী দেশের মধ্যে একাধিক কণ্টকাকীর্ণ সমস্যা সমাধানে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগে একমত নই। ওয়াশিংটন বিশ্বাস করে, চীনারা দীর্ঘকাল ধরে আলোচনা এবং অস্থায়ী সমঝোতার পক্ষে।
এখন রাজনীতিকৃত এবং ব্যক্তিগতকৃত কূটনীতির চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ৫০ বছর আগে যে পদ্ধতি কাজ করেছিল তা আজ কাজ করে না। উভয় দেশের জন্যই প্রেক্ষাপট এখন ভিন্ন। চীন এখন ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় বৈধ প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী। সে যুগে দ্বন্দ্ব নিরসনে নিক্সনের চীন সফর যথেষ্ট হলেও এখন তারচেয়ে অনেক বেশিকিছু প্রয়োজন।
মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কূটনীতি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি নতুন ভিত্তিপ্রস্তর প্রয়োজন। তাই অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই মার্কিন-চীন বিরোধ নিষ্পত্তির কঠিন লক্ষ্য বাস্তবায়নে একটি নতুন সচিবালয় দরকার।
মূল লেখা- স্টিফেন এস রোচ (Stephen S. Roach)
ভাষান্তর: মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন