পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ নিয়ে রয়েছে বহু সমালোচনা। গত কয়েকমাস ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে যে দমনপীড়ন চালানো হয়েছে তা পাকিস্তানের রাজনীতিকে আরও বেশি কলুষিত করেছে। গত আট মাস কারাগারে রয়েছেন ইমরান খান। সমর্থকরা দাবি করছেন তাকে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে।
নির্বাচন থেকে পিটিআইকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পিটিআইয়ের দলীয় কার্যালয়গুলোতে নিয়মিত পুলিশি অভিযান চালানো হয়েছে। নির্বাচনে পিটিআইয়ের দলীয় প্রতীককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং পিটিআইয়ের নির্বাচনী প্রচারণাগুলো টেলিভিশনে সম্প্রচার করতে দেওয়া হয়নি। পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীদের স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে বাধ্য করা হয়েছে।
কিন্তু এতকিছুর পরেও পাকিস্তানের যুবকরা অর্ধ শতাব্দীতে এই দেশে সবচেয়ে বড় নির্বাচনী চমক দেখিয়েছে। নির্বাচনে ইমরান খান সমর্থিত প্রার্থীরা সংসদে অন্য যে কোনো দলের চেয়ে বেশি আসন পেয়েছেন। পাকিস্তানে ১২ কোটি ভোটার রয়েছে এবং ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে তারা গতানুগতিক রাজনীতির নিয়মকে উল্টে দিয়েছেন। নির্বাচন শেষে পিটিআইয়ের সমর্থনে রাস্তায় নামা লক্ষাধিক তরুণ ভোটার স্রোগান দিচ্ছিলেন তারা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ মালিক বলেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে পুরোনো পদ্ধতি আর কাজ করবে না, সেটাই নির্বাচনের ফলাফলে দেখিয়েছে জনগণ। সেনাবাহিনী যদি এখনও তার প্রভাব বজায় রাখতে চায় এবং রাজনীতিতে তার প্রবাব ধরে রাখতে চায় তবে তাকে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। পিটিআই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাবার পরেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠন করতে পারছে না। ইমরান খান শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসবেন তেমন সম্ভাবনা নেই কারণ পিটিআইয়ের সুস্পষ্ট কোনো জোট অংশীদার নেই।
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল ঘোষণা করেছে, তারা পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও অন্য ছোট দলগুলোর সঙ্গে জোট সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। নওয়াজ শরিফ তার ছোট ভাই শাহবাজ শরীফের কাছে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেবেন। ২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে একটি নড়বড়ে জোট সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন শাহবাজ শরিফ। দলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নতুন জোট সরকারেরও নেতৃত্ব দেবেন তিনি। তবে এই জোট সরকার খুববেশি স্থায়ী হবে না বলে ইতোমধ্যেই মত দিয়েছেন কিছু বিশ্লেষক।
ইমরান খান প্রতিষ্ঠিত পিটিআইয়ের দলীয় প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট। এই প্রতীকের প্রতি পাকিস্তানের মানুষের একটি বড় আবেগ রয়েছে। পাকিস্তানের ৪০ শতাংশ মানুষ পড়তে পারেন না। এই বৃহৎ সংখ্যক নিরক্ষর ভোটাররা ব্যালট পেপারে ইমরান খান এবং তার দলকে খুঁজে বের করার জন্য ক্রিকেট ব্যাট প্রতীক খোঁজেন। কিন্তু নির্বাচনে পিটিআইয়ের স্বীকৃত ক্রিকেট ব্যাট প্রতীক নিষিদ্ধ করা হয়। পিটিআইয়ের প্রার্থীরা তখন গ্রামীণ ভোটারদের কাছে তাদের নতুন প্রতীক প্রচার করতে TikTok-এর সাহায্য নেন। দলের নেতাকর্মীরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে ইমরান খানের বক্তব্য প্রচার করেন যা সবাইকে অবাক করে দেয়। এমনই এক ভিডিও বক্তৃতায় নির্বাচনে বিজয়ের ঘোষণা দিয়ে ইমরান খান বলেন : ‘আপনারা সত্যিকারের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করেছেন।’
পিটিআই-এর নির্বাচনী প্রচারণা থেকে টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোকে আটকে রাখলেও ডিজিটাল প্রচারণায় সফলতা দেখায় পিটিআই। পিটিআইয়ের বার্তা ডিজিটাল-বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণ ভোটারদের স্পর্শ করে। তরুণ ভোটাররা ইমরান খানকে এতটা গ্রহণ করবে সেটা বুঝে উঠতে পারেননি ইমরান খানের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা। তরুণদের কাছে নিজেকে পৌঁছে দিতে পেরেছেন ইমরান খান এবং পাকিস্তানের নতুন তরুণ ভোটাররা সবাই পিটিআইকে ভোট দিয়েছে।
পাকিস্তানের তরুণরা অনেকে দেশের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং স্থবিরতায় বিরক্ত। ব্যাপক দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক স্থবিরতার জন্য তারা কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আধিপত্যকারী শরিফদের মতো পারিবারিক রাজবংশকে দায়ী করে। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণের মুখে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এই অনুভূতিগুলো এতটা কঠোর এবং প্রকাশ্যে আগে কখনোই উচ্চারিত হয়নি। মানুষ একইভাবে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও মুখ খুলছে।
বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরেও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। ইমরান খানের সমর্থকরা সন্দেহ করেন, নির্বাচনে জালিয়াতি করার জন্যই দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে যাতে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয় তার জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। মে মাসে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের প্রেক্ষিতে পিটিআই সমর্থকদের দেশব্যাপী অবদান নেওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করেছেন কর্মকর্তারা। সেসময় যে দাঙ্গা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের মার্কিন ক্যাপিটাল হিলে হামলার সঙ্গে তুলনা করেছিল পাকিস্তান সরকার।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তানের সামরিক প্রধান আসিম মুনির ডিসেম্বরে বলেছিলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া উদ্বেগ, হতাশা এবং বিশৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি করে।’ তবে পিটিআই এবং এর সমর্থকরা বলছেন, ‘হুমকি হওয়ার পরিবর্তে ইন্টারনেট পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও সচেতন করে তুলতে পারে। বিশেষ করে গ্রামীণ যুবকদের সংগঠিত করতে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে টিকটক। টিকটক-এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ নিরক্ষর ভোটারদের কাছে বার্তা পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে পিটিআই।’ উল্লেখ্য, পাকিস্তানে ফেসবুক, টুইটার এবং অন্যান্য মেসেজভিত্তিক সামাজিক প্ল্যাটফর্ম কম ব্যবহৃত হয়।
পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এক গ্রামে বসবাস করেন ২২ বছর বয়সী আসিম আমিন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের আগে টিকটকে আমি ইমরান খানের বক্তব্য দেখেছি যা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। যদিও কারাবন্দি ইমরান খান ব্যক্তিগতভাবে প্রচারণা চালাতে পারেননি, তবে আসিম আমিনের মতো তরুণরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তৈরি খানের বক্তব্য শুনেছেন। আসিম আমিন বলেন, খান আমাদের দেশের প্রকৃত নেতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ মালিক বলেন, ‘ভবিষ্যতে পাকিস্তানি দলগুলোকে ভোট জিততে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। গত সপ্তাহের নির্বাচনের ফলাফল সেরকমই ইঙ্গিত দেয়। পাকিস্তানে এবারের নির্বাচনই প্রথম কোন নির্বাচন যেখানে প্রার্থী ভোটার খুঁজছিলেন না, বরং ভোটাররা প্রার্থী খুঁজছিলেন।’
রিক নোয়াক : সাংবাদিক; ওয়াশিংটন পোস্টের আফগানিস্তান ব্যুরো প্রধান। ভাষান্তর : মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন