রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়। প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ তাদের কূটনীতি ও নিরাপত্তা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে শুরু করে। চলমান এই সংকট ইতোমধ্যে বেশ বিরোধিতামূলক পরিণতি তৈরি হয়েছে। এতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো বুমেরাংয়ের মতো নিজেদেরকেই এ দ্বন্দ্বের অগ্রভাগে দেখতে পাচ্ছে। সমস্বরে রুশ বিরোধিতার ঠিক দুই বছর পরেই এমন ধারণা তৈরি হওয়ায় বিশ্ব মোড়লদের ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ফের ভাবাচ্ছে।
তবে আটলান্টিকের ওপারের রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা অনেক জোরদার হচ্ছে এবং ফ্রান্সই বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি উস্কে দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর একটি ঘোষণা সামনে আসে। তিনি জানিয়েছেন, ফরাসি প্রজাতন্ত্র অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনে তার সেনা পাঠাবে না। এর আগে তিনি বলেছিলেন, পশ্চিমা নেতারা ইউক্রেনে সেনা পাঠানো নিয়ে আলোচনা করেছেন কিন্তু এখনো কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেননি।
যুদ্ধক্ষেত্রে ন্যাটো সৈন্য পাঠানোর সম্ভাবনা সম্পর্কে ম্যাক্রোঁর বক্তব্য অনেকের কাছে স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু ঠিক এক সপ্তাহ পরে প্যারিসের দাবি, এ বক্তব্য ইচ্ছাকৃত ও সুচিন্তিত ছিল। বহু বছর ধরে ফ্রান্স ইইউকে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ সম্পর্কে চিন্তা করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। তবে খুব কম মানুষই এর মমার্থ বুঝতে পেরেছিলেন।
১৩ বছর আগে যখন লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে ন্যাটোর হস্তক্ষেপের উদ্যোগ পশ্চিম ইউরোপীয়দের কাছ থেকে এসেছিল, মূলত ফরাসিদের কাছ থেকে, তারা এ বিষয়ে বিভিন্ন যুক্তিও তুলে ধরেছিল। রাষ্ট্রপতি নিকোলাস সারকোজির সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণ (মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে তার আর্থিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের গুজব) থেকে একটি দুর্বল শত্রুর বিরুদ্ধে সহজে বিজয় অর্জনের ইচ্ছার কথাও আলোচিত হয়েছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, যিনি তার বেশিরভাগ পূর্বসূরিদের মত সামরিকবাদী ছিলেন না, তিনি অবশ্য এ হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ততটা উৎসাহী ছিলেন না।
লিবিয়ায় ইউরোপীয় মিত্রদের ব্যর্থতা ওয়াশিংটনের জন্যও দুর্ভাগ্যজনক ছিল। ফলে ওয়াশিংটনকে এর জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। ফলাফলটি সুপরিচিত – তারা যা চেয়েছিল তা পেয়েছে (গাদ্দাফিকে উৎখাত ও হত্যা)। কিন্তু তার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে লিবিয়াকে। আর সেটি হচ্ছে একটি দেশ হিসেবে চরম পতন এবং দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা। বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সেই পরিস্থিতির তুলনা করার কোনো মানে নেই। কারণ দুটি পরিস্থিতির গঠন এবং স্কেল উভয়ই আলাদা।
ইউক্রেন যুদ্ধের পেক্ষাপটে বর্তমান পশ্চিম ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়া এবং রাশিয়ান হুমকি বৃদ্ধি অন্য একটি কারণের সাথে যুক্ত। চলমান সংঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ইইউসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ। ইতোমধ্যে তারা বহুমুখী নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভুগতে শুরু করেছে। যা জার্মানির দিকে তাকালে আরও স্পষ্ট হয়। কিন্তু এই যুদ্ধে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে তাদের ইউরোপীয় অংশীদাররা কী পাবে বা কী আশা করবে সেটি সম্পর্কেও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না কেউ। যার অর্থ দাঁড়ায় পরিস্থিতি এখনও ঘোলাটে এবং মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।
সদ্য অনুষ্ঠিত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ইইউ রাষ্ট্রদূতদের একটি বৈঠকে আমন্ত্রণ জানালেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। রুশ এ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, ইউরোপীয় দেশগুলোর কূটনৈতিক মিশনগুলো কীভাবে নির্বাচনের জন্য ‘প্রস্তুতি’ নিচ্ছে, নন-সিস্টেমিক বিরোধীদের সমর্থন করার জন্য প্রকল্প তৈরি করছে এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে সে সম্পর্কে মস্কোর কাছে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে। পরিকল্পিত বৈঠকে, ল্যাভরভ বিদেশি কূটনীতিকদের এই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়ার জন্য পরামর্শ দিতে চেয়েছিলেন, বিশেষ করে দূতাবাসগুলোর এই ধরনের প্রকল্পগুলো চালানোর কোনও অধিকার নেই, সেই বিষয়ে অবগত করতে চেয়েছিলেন।
এরমধ্যে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা জানান, ‘সভার ঠিক আগে, আমরা একটি ফ্রান্সের কাছ থেকে একটি বার্তা পেয়েছি যে তারা না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা কি এমন রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক স্তরে সম্পর্ক কল্পনা করতে পারেন যাদের রাষ্ট্রদূতরা স্বীকৃত দেশের মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আসতে ভয় পান? এই মিত্র অংশীদারদের আচার-ব্যবহারে এটাই ঘটেছে।’
তার মতে, পশ্চিমা এবং ন্যাটো দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের পাশাপাশি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সাথে জড়িত। তারা আর তাদের আসল কাজ করছে না।
রাশিয়ান নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ, ল্যাভরভের সঙ্গে দেখা করতে অনাগ্রহীদেশের রাষ্ট্রদূতদের বহিষ্কারের পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, এই ধরনের আচরণ কূটনৈতিক মিশনের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তিনি তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন, ‘এই রাষ্ট্রদূতদের রাশিয়া থেকে বহিষ্কার করা উচিত এবং এ দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের স্তর কমানো উচিত।’
এদিকে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৯৫ দশমিক ০৮ শতাংশ ভোট গণনা শেষ হয়েছে। এতে পুতিন সর্বোচ্চ ৮৭ দশমিক ৩২ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। যার অর্থ হচ্ছে- আরও ছয় বছরের জন্য পুতিনের ক্ষমতা পাকাপোক্ত হতে যাচ্ছে। পুতিন আবারও ক্ষমতা নিশ্চিত করার পর ইউক্রেন ইস্যু কোন দিকে গড়ায় সেটিই দেখার বিষয়।
মন্তব্য করুন