১৬৬০ সালের আগস্ট মাসের কোনো এক সকালে ৭৩ বয়সী শৌখিন জমিদার উইলিয়াম হ্যারিসন প্রজাদের কাছ থেকে পাওনা টাকা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেও যখন টাকা নিয়ে হ্যারিসন বাড়ি না ফেরেন তখন তার স্ত্রী দুশ্চিন্তায় পড়েন।
তিনি তাদের কাজের ছেলে জন পেরি’কে পাঠান হ্যারিসনের খোঁজে। পেরি হ্যারিসনকে খুঁজতে খুঁজতে গভীর রাত হয়ে যায়। সে আর বাড়ি ফেরে না।
ভোর হয়ে গেলে স্বামী ও কাজের ছেলে উভয়েই যখন লাপাত্তা তখন হ্যারিসনের স্ত্রী তাদের বড় ছেলে এডওয়ার্ডকে বলেন, দ্রুত স্বামী ও গৃহভৃত্য পেরির খোঁজে বেরিয়ে পড়তে। এডওয়ার্ড অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার বাবা হ্যারিসনকে না পেলেও পেরিকে পান। পরে দু’জনে সারা দিন তন্নতন্ন করে হ্যারিসনকে খুঁজতে থাকেন।
আশপাশের সকল গ্রাম খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে যখন ফিরছিলেন তখন হঠাৎ এডওয়ার্ড ও জন পেরি দেখতে পান সড়কে পড়ে আছে হ্যারিসনের রক্তমাখা ক্যাপ, নেক টাই ও শার্ট। সবাই তখন ধরে নেন হ্যারিসন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কেউ তাকে টাকার জন্য খুন করেছে এবং লাশ গুম করে ফেলেছে।
ধীরে ধীরে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। খুনটি কে করেছে। প্রথমে সন্দেহ হয় কাজের ছেলে জন পেরিই সেই খুন করেছে। কারণ সেদিন পেরি হ্যারিসনকে খুঁজতে গিয়ে রাতে ফেরেনি। সারা রাত সে বাইরে কী করছিল!
কিন্তু পেরি বলছে ভিন্ন কথা। হ্যারিসনকে খুঁজতে খুঁজতে তার গভীর রাত হয়ে যায় এবং আঁধারে সে বাড়ি ফেরার পথ ভুলে যায়। তাই ফিরতে পারেনি। তথাপি পেরিকে আটক করা হয়।
হঠাৎ হ্যারিসনের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি অন্যদিকে মোড় নেয়। বিচারককে পেরি দেয় চাঞ্চল্যকর এক তথ্য। সে বলে তার মা জোয়ান ও ছোট ভাই রিচার্ড টাকার জন্যই হ্যারিসনকে হত্যা করেছে এবং তারা তার লাশ পুকুরে ফেলে দিয়েছে। তারা সবাই মিলে এ পরিকল্পনা করে।
সে আরও বলে, এর আগেও বেশ কয়েকবার তার ভাই ও মা হ্যারিসনদের বাড়ি থেকে টাকা চুরি করেছে।
রাজসাক্ষী হয়ে নিজের আপন ভাই ও মাকে খুনি সাব্যস্ত করায় কারোরই আর সন্দেহ থাকে না যে, নিখোঁজ হ্যারিসনকে কারা খুন করেছে। তারপরও ডেড বডি না পাওয়ায় বিচারক ইতস্তত ছিলেন। চারদিকে তন্নতন্ন করে হ্যারিসনের লাশ খুঁজতে লাগল সবাই। কিন্তু কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি সেই রক্ত মাখা শার্ট, নেক টাই আর ক্যাপ ছাড়া।
হ্যারিসনের লাশ পাওয়া না গেলেও অবশেষে সারকামস্টেনসিয়াল এভিডেন্স বা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে বিচারক গৃহভৃত্যের পুরো পরিবারটিকেই হ্যারিসন হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকায় ফাঁসির রায় দেন। একযোগে তাদের সবার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
নিখোঁজ হওয়ার পর লাশ পাওয়া না গেলে তিনি খুন হয়েছেন বা মারা গেছেন চট করে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছা আইনত জটিল। এ অভিযোগে কাউকে শাস্তি দেওয়াটাও বিচার কার্যের জন্য অত্যন্ত কঠিন। তথাপি সারকামস্টেনসিয়াল এভিডেন্স বা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে বিচার কার্যে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেই হয়। কিন্তু প্রায় চারশ বছর আগে হ্যারিসনের নিখোঁজ হওয়া অতঃপর হত্যাকাণ্ডের রায়ে তিনজনের ফাঁসি হওয়ার ঘটনাটি আজও সারা বিশ্বের বিচার কার্যের জন্য এক অনাকাঙ্ক্ষিত বা রহস্যময় ঘটনা। কেন?
আসুন জেনে নেই সেই মর্মান্তিক কাহিনি।
নিখোঁজ হওয়া হ্যারিসন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এবং এ হত্যাকাণ্ডের বিচারে অভিযুক্ত গৃহভৃত্যদের সপরিবারে ফাঁসি হবার দুই বছর পর হঠাৎ করে উদয় হন নিখোঁজ উইলিয়াম হ্যারিসন!
হ্যারিসন জানান, প্রজাদের কাছ থেকে পাওনা টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তিনি কতিপয় ছিঁচকে ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েন। তারা তাকে প্রহার করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে বিক্রি করে দেয় জলদস্যুদের কাছে।
এরপর হাত ঘুরে ঘুরে তার ঠিকানা হয় অটোমান সাম্রাজ্যের এক সম্ভ্রান্ত চিকিৎসকের বাড়িতে, দাস হিসেবে। সেই চিকিৎসকের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে হ্যারিসন মুক্ত হন এবং তিনি সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে কোনোমতে সোজা বাড়ি ফেরেন।
কিন্তু দু’বছর পর অকস্মাৎ নিখোঁজ স্বামীকে দোয়ারে দেখে হ্যারিসনের স্ত্রী হয়ে যান বাকরুদ্ধ। প্রচণ্ড গিলটি ফিলিংস থেকে তিনি সুইসাইড করেন। কারণ হ্যারিসনের জন্যে তারই অভিযোগের ভিত্তিতে তিন তিনজন নিরপরাধের ফাঁসি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। প্রায় চারশ বছর আগের এ ঘটনাটি আজও সারা বিশ্বের বিচার কার্যের জন্য একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
এ জন্য অনেক সময় বলা হয় 'নো ডেড বডি, নো ক্রাইম' অর্থাৎ ডেড বডি না পেলে হত্যাকাণ্ড বলাটা কঠিন অথবা নিখোঁজ মানেই মৃত নয়।
যাহোক, আইনে আছে কোনো কারণ ছাড়াই কেউ যদি ন্যূনতম ৭ বছর সন্দেহজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান তাহলে পরিবারের দাবির ভিত্তিতে, কিংবা উত্তরাধিকারবিষয়ক জটিলতা এড়াতে তাকে মৃত ঘোষণা করা যেতে পারে। তবে সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর (ন্যূনতম ৭ বছর) এবং অবশ্যই সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্সের ভিত্তিতে।
তারপর কেউ যদি দীর্ঘদিন নিখোঁজ হবার পর মৃত ঘোষিত হন এবং তিনি যদি ফের ফিরে আসেন তাহলে তাকে জীবিত ঘোষণা করাটাও আরেক জটিল। তখন তাকে আদালতে গিয়ে জীবিত আছেন সেটা প্রমাণ করতে হয়। এ মর্মে নানা রকমের সাক্ষী-প্রমাণ দাখিল করতে হয়। যা মৃত ঘোষিত হবার চেয়েও কঠিনতর।
তাই বলা হয়, কাগজপত্রে কেউ যদি একবার মৃত ঘোষিত হয়ে যান তাহলে তিনি জীবিত আছেন সেটা পুনরায় প্রমাণ করা অনেক অনেক জটিল একটি বিষয়। অনেক সময় দেখা যায়, সমাজের দুষ্টু লোকেরা সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে অনেক সময় মৃত হবার নাটক সাজায়। আবার কিছু রহস্যময় মানসিক রোগ আছে যাতে আক্রান্ত হলে অনেক সময় রোগী অতীতের সব ভুলে যান, নিরুদ্দেশ হয়ে যান কিংবা নতুন পরিচয় নিয়ে নতুন কোথাও দিনাতিপাত করতে থাকেন; আবার যখন তার হারানো ‘মেমোরি ও ইনসাইট’ ফিরে আসে তখন তিনি পুনরায় ফিরে আসেন।
ডা. সাঈদ এনাম এমবিবিএস (ডিএমসি) এমফিল (সাইকিয়াট্রি) সহকারী অধ্যাপক, সিলেট মেডিকেল কলেজ। ইন্টারন্যাশনাল ফেলো, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন
মন্তব্য করুন