ড. মো. শফিকুল ইসলাম
প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৪, ০৬:১৭ পিএম
আপডেট : ৩১ মে ২০২৪, ০৯:৫৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শিশুদের প্রতি পরিবারের বেশি মনোযোগী হওয়া জরুরি

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তারাই আগামী দিনের সমাজ ও বিশ্ব গড়বে। কিন্তু আমরা কি শিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালন করে? এটাই প্রশ্ন। তাই তাদের অধিকার সুনিশ্চিত, মানসিক বিকাশে সহায়তা করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

করোনা পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। বর্তমানে ডেঙ্গু মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। যদিও সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে থেমে থাকেনি শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন। ধর্ষণ, ডেঙ্গু, বাল্যবিবাহ, শিশু নির্যাতন যাওয়ার খবর আমাদেরকে আহত, ক্ষত-বিক্ষত করে চলছে। কারণ প্রায়ই খবরের কাগজে এসব দুর্ঘটনা দেখতে পাই। যা খুবই দুঃখজনক। কী যে খারাপ সময় অতিবাহিত করছে দেশ ও জাতি? যা নিয়ে সরকার, অভিভাবক এবং আমরা সবাই দুশ্চিন্তায় রয়েছি। এসব থেকে আমাদের খুব শিগগিরই মুক্তি পাওয়া দরকার। অন্যথায়, আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে।

এই শিশুরাই ভবিষ্যতে দেশ নেতৃত্ব দিবে। তাদেরকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করা সরকার এবং আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শিশু নির্যাতন একটি সামাজিক সমস্যা। শুধু আইন দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। সামাজিকভাবেই এটি মোকাবিলা করতে হবে।

গত ৮ মাসে দেশে ৪৯৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া উক্ত সময়ে ১০১ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। যার মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৩২২ জন, গণধর্ষণের শিকার হয় ৭২ জন্য কন্যাশিশু, প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু রয়েছে ৩৯ জন। প্রেমের ফাঁদে ফেলে ৭০ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও চলতি বছরের গত ৮ মাসে মোট ৩২৯ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই সময়কালে পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ৩০ জন কন্যাশিশু।

এ ছাড়া দেশে ২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ৩৬০ জন নারী। এর মধ্যে ৪৫০ জনকে আবার ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। একইসময়ে সারা দেশে সহিংসতার শিকার হয় ৯ হাজার ৭৬৪ জন নারী। আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৩ উপলক্ষ্যে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লাইট হাউস এ সব তথ্য প্রকাশ করে। যা খুবই ভয়াবহ। প্রশ্ন হল কেন এসব ধর্ষণের মত ন্যক্কারজনক ঘটনা বারবার ঘটে। সঠিক বিচার হলে এসব বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। তাই বিচারহীনতার সংস্কৃতি বা সামাজিক অবক্ষয় এজন্য অনেকাংশে দায়ী।

সমাজে শিশু নির্যাতন বা ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধ প্রবণতা এমন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিশুদের মনে এক আতঙ্ক এবং ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। শিশুরা যেখানে যায়,সেখানে তাঁরা ভীতিতে বসবাস করে। যা কোনোভাবে হওয়া উচিত নয়। এভাবে শিশুরা আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে উঠলে তাঁদের ভিতরে সুস্থ বুদ্ধি, মননশীল চিন্তা-চেতনা বা সৃজনশীল মেধার বিকাশ হওয়া কঠিন।

এ ছাড়াও ধর্ষণ বন্ধে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ আমাদের দেশে ছেলে মেয়েদের জন্য আলাদা স্কুল থাকায়, একে অপরের প্রতি এক ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি হয়। নানান ধরনের নেতিবাচক চিন্তা শিশুদের মনে আসে। ফলে ছেলেদের মনে ধর্ষণ বা খারাপ কাজের প্রবণতা সৃষ্টি হয়ে থাকে অনেক সময়। তাই আমি মনে করি, শিশুকাল থেকে ছেলে মেয়েদের জন্য পৃথক স্কুল না থাকাই ভালো। যাতে একে অপরকে বন্ধু এবং নিকটতম সঙ্গী ভাবতে পারে।

চলতি বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১০০০ জনের বেশি; এরমধ্যে ১-১৫ বছর বয়সী শিশু রয়েছে একশ বা তার বেশি। এর আগে কখনও দেশে ডেঙ্গুতে এত শিশুর মৃত্যু হয়নি।দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, ডেঙ্গুর লক্ষণ পরিবর্তন, দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে আসার কারণে শিশুমৃত্যু বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই শিশুদের প্রতি বেশি নজর দিতে হবে যাতে তাঁরা ডেঙ্গু আক্রান্ত না হয়।

বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ কর্তৃক বাংলাদেশ পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলে প্রতিবছর প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। তবে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা তিন-চতুর্থাংশের বেশি।গণমাধ্যমে জানতে পারি, বাংলাদেশে প্রতিদিন অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় গড়ে ৪০ জন। প্রতিদিন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মারা যায় গড়ে ৩০ জন। ফলে প্রতি বছরে প্রায় ১১ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে।

কোভিড-১৯ সংকট শিশুদের উপর অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যেমন দারিদ্র্যের ঝুঁকি বাড়িয়েছে, শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে অনেক নেতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে এবং সহিংসতা এবং অপব্যবহারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্বেগজনক চিত্র কারোই খুব বেশি অজানা নয়। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি–২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের সময়ে বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সি মেয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিয়ের হার ২৭ শতাংশ। যা খুবই বিপজ্জনক। শিশুরা এমনি করোনা বা করোনা পরবর্তী সময় বেশি মানসিক বিপদগ্রস্ত হচ্ছে, তাই মা-বাবা শিশুদেরকে সময় দিয়ে এই সমস্যা থেকে বের হতে হবে। করোনায় তাঁরা মোবাইল বা ইন্টারনেটের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে যা তাদেরকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। তাই পিতামাতাকে তাদের সন্তানদের প্রতি বেশি মনোযোগী হতে হবে যাতে শিশুরা ভুল পথে না যেতে পারে।

ফুল যেমন পাপড়ি মেলে সৌরভ ছড়ানোর অপেক্ষায় থাকে, তেমনি শিশুরাও একদিন ফুলের মত সৌরভ ছড়াবে এই অপেক্ষায় থাকে দেশ, কিন্তু প্রতিদিন নির্মম কিছু দুর্ঘটনা দেখতে পাই, যা মেনে নিতে কষ্ট হয়। বিকশিত হওয়ার পূর্বে অনেক নিষ্পাপ শিশুকে আমরা অকালে হারিয়ে ফেলি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিশুদের ধর্ষণ ও নির্যাতন, পানিতে ডুবে বা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া খুবই দুঃখজনক। এসব আমাদের প্রবল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার, এক একটি শিশু এক একটি স্বপ্ন ও ফুল। সর্বোপরি সরকারকে আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে ধর্ষকদের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির ব্যবস্থা করতে হবে, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও অন্যান্য বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এটাই আমাদের দাবি।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক,হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ,জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আইনজীবী তালিকাভুক্তির লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ

টাইলস পরিষ্কার করবেন যেভাবে

সীমান্ত দিয়ে ৬০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে বিএসএফ

‘নিজামী, মীর কাসেম ও সালাউদ্দিন কাদেরকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে’

ভাতের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনে তৈরি ৬০০ মিটার লম্বা রাইস কেক

সালমানকে নিয়ে মন্তব্য করে তোপের মুখে সোহেল রানা

গাজায় যুদ্ধবিরতি সমন্বয় কেন্দ্রের বেসামরিক প্রধান নিয়োগ দিল যুক্তরাষ্ট্র

কুয়াকাটায় সব হোটেল-মোটেল বন্ধের ঘোষণা

নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যে নেতাদের কাজ করার আহ্বান সেলিমুজ্জামানের 

মারা গেল গাজীপুর সাফারি পার্কে বেঁচে থাকা সর্বশেষ জিরাফ

১০

এইচএসসির পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশের সম্ভাব্য তারিখ জানা গেল

১১

বিশ্বকাপ চলাকালেই হয়রানির শিকার দুই নারী ক্রিকেটার

১২

এখন থেকেই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে হবে : রাশেদ প্রধান

১৩

কর্মস্থলে যোগদানের দিনেই প্রাণ গেল পুলিশ সদস্যের

১৪

ছবিতে কতগুলো সংখ্যা লুকিয়ে আছে? ৯৯% মানুষই ভুল করেন উত্তর দিতে

১৫

কিশোরের পেটে ১০০ শক্তিশালী চুম্বক, অতঃপর...

১৬

‘হৃদরোগ প্রতিরোধে উত্তরাঞ্চলে বড় ভূমিকা রাখবে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন’

১৭

মারা গেলেন ঘরে ৩ বস্তা টাকা পাওয়া সেই ভিক্ষুক

১৮

ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র ছায়া সংসদ / গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় ন্যায়পাল নিয়োগ প্রয়োজন 

১৯

লাখ টাকা বেতনে কর্মী নেবে প্রবাসীর সিটি

২০
X