জুলাই, ১৯৮৩। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের জন্য এমনকি শ্রীলঙ্কার ভাগ্যের জন্যও কালো অধ্যায় রচিত হয় এ মাসেই। দেশের তামিল সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায় এবং সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চালানো গণহত্যায় মাত্র ৭ দিনেই প্রাণহানি ঘটে ৫ হাজার ৬৩৮ জন তামিল নারী, শিশু ও পুরুষের। ব্যাপক সহিংসতা, ধ্বংসযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় তামিলদের গ্রাম ও বসতিগুলোতে। ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ হন গৃহহীন।
সহিংসতাগুলো ছিল দেশের মধ্যে উপস্থিত গভীর জাতিগত উত্তেজনা এবং নিবিষ্ট জাতি-সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের বহিঃপ্রকাশ, যা শ্রীলঙ্কার-বৌদ্ধ আধিপত্যকে সর্বোপরি বহাল রাখে। এই গণহত্যা শ্রীলঙ্কায় এক সুদীর্ঘ গৃহযুদ্ধের সূচনা করে।
“ব্ল্যাক জুলাই” নামে চিহ্নত সেই গণহত্যার মধ্যেই লন্ডন ডেইলি টেলিগ্রাফের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জে. আর. জয়াবর্ধনে বলেছিলেন: ‘সত্যিই, আমি যদি তামিল জনগণকে ক্ষুধার্ত করে দেই তবে সিংহলের জনগণ খুশি হবে।’
সাধারণত রাজনীতিবিদদের তাদের অপকর্মের গোপন বাসনা মুখে উচ্চারণ করতে দেখা যায় না। তবুও জয়াবর্ধনের নির্লজ্জ বক্তৃতা তার পরবর্তী ৪০ বছরের শ্রীলঙ্কার রক্তাক্ত ইতিহাসের গতিপথকে পূর্বাভাস দেয়। এটি এমন একটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে যে রাষ্ট্রটি একসময় এশিয়ার মুক্তা নামে পরিচিত ছিল।
ব্ল্যাক জুলাইয়ের পরপরই, শ্রীলঙ্কায় একটি ৩০ বছরের দীর্ঘ নৃশংস সশস্ত্র সংঘাত নেমে আসে। যার শেষ হয় ২০০৯ সালের ‘মুল্লিভাইক্কাল’ গণহত্যার মধ্য দিয়ে। এই দীর্ঘ সময়ে রয়েছে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অসংখ্য অভিযোগ। দেশটি ক্রমাগত সংকটে জর্জরিত, যার ফলে ২০২২ সালে প্রায় সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পতন ঘটে শ্রীলঙ্কার। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পতনের শিকড়গুলো খুঁজতে গেলে ব্ল্যাক জুলাইয়ে ফিরে যেতে হবে আমাদের।
২৩ থেকে ৩০ জুলাই, সাধারণ তামিলরাও তাদের প্রতিবেশী সিংহল সম্প্রদায়ের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। সশস্ত্র সিংহল জনতা গণহারে তামিলদের হত্যা করতে বৃদ্ধ, নারী, শিশু কোনো কিছুই বিচার করেনি। তামিলদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছুই ধ্বংস করা হয়।
এই সময়টি তামিলদের বাস্তুচ্যুতির সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তামিলরা শহরের কেন্দ্রগুলোতে তাদের বাড়িঘর এবং ব্যবসা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তারা তামিল-অধ্যুষিত উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মধ্যে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশে আশ্রয় খুঁজতে শুরু করে। লাখ লাখ তামিল দ্বীপ থেকে পালিয়ে যায়। এরপর বছরের পর বছর ধরে তামিলরা সংগ্রাম করে চলেছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং নির্বাসিত হয়েছে।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা একটি জাতি প্রধান টাইম লুপে আটকে আছে। শ্রীলঙ্কায় সশস্ত্র সংঘাতের অবসানের পনেরো বছর পর, ব্ল্যাক জুলাইয়ের সেই দাগগুলো আজ অনুরণিত হতে থাকে। যা দেশটির অগ্রগতি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। দ্বীপের তামিল অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বঞ্চিত। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ট সিংহলি-অধ্যুষিত সামরিক বাহিনীর বিশাল উপস্থিতি রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে তামিল ভূমির বিশাল অংশ বেআইনিভাবে দখল করা এবং তামিলদের নাগরিকদের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অধিকারকে দমনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দেশের সীমানার মধ্যে জাতিগত-সংখ্যাগরিষ্ঠ নীতি এবং কুসংস্কারমূলক অনুশীলনগুলো ভয় এবং বর্জনের একটি আবহ তৈরি করে; যা বিনিয়োগ এবং উৎপাদনের ওপর ছায়া ফেলে একটি সমৃদ্ধিশালী সমাজের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। অতীতের নৃশংসতার জন্য জবাবদিহি এবং ন্যায়বিচারের অভাব দেশবাসীকে একটি শীতল বার্তা দেয় যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধগুলো শাস্তির বাইরে থেকে যেতে পারে, যা বৈশ্বিক অঙ্গনে জাতির বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও ম্লান করে তোলে। যতক্ষণ না ব্ল্যাক জুলাইয়ের মূল কারণগুলো চিহ্নিত এবং পরবর্তী সংঘাতের পুরোপুরি তদন্ত ও বিচার না করা হয়, ততক্ষণ শ্রীলঙ্কার উন্নয়ন তার অতীতের ‘পাপ’ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে।
সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থাকা সত্ত্বেও আজ অবধি ব্ল্যাক জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া সেসব অপরাধের জন্য কোনো সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ বা বেসামরিক ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। এটি শ্রীলঙ্কাকে দায়মুক্তির একটি গুমোট সংস্কৃতি উপহার দিয়েছে। যেখানে অপরাধ সংঘটন বা নৃশংসতা চালানোর জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক নেতাদের মধ্যে গণ্য করা হয়। জয়াবর্ধনের প্রতিষ্ঠিত সিংহল-বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ আজও দেশটিতে অব্যাহত রয়েছে। বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ সেখানে রাষ্ট্রীয় শাসনের সঙ্গে জড়িত। এটি দেশে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যার ফলে প্রতিদিনই যেখানে তামিল সাধারণ মানুষের মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হয়।
ব্ল্যাক জুলাইয়ের অতীত সমসাময়িক শ্রীলঙ্কায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। যা দেশের সামাজিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ব্ল্যাক জুলাইয়ের ঐতিহাসিক অন্যায়কে স্বীকার করা এবং তার বিচার করা, তামিল সম্প্রদায়ের ওপর এর সুনির্দিষ্ট প্রভাবকে স্বীকার করা এবং তামিল সম্প্রদায়ের অভিযোগের আশু সমাধান করা শ্রীলঙ্কায় একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মূল - অর্চনা রবিচন্দ্রদেব এবং অম্বিহাই আকিলান (Archana Ravichandradeva and Ambihai Akilan)
ভাষান্তর - মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন