আর মাত্র ১৮ ঘণ্টা পরেই আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে হওয়া ফাইনাল ম্যাচ দিয়ে পর্দা নামবে আইসিসি ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপের ১৩তম আসরের। ৫ অক্টোবর একই মাঠে হওয়া নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে পর্দা উঠেছিল ১০ জাতির এ আসরের। আগামীকালের ভারত অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ দিয়ে যার পূর্ণতা পাবে। প্রায় দেড় মাসের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার এই ফাইনালের মঞ্চে আসার আগে পাড়ি দিতে হয়েছে ১০টি ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে সে যাত্রা কঠিন হলেও ভারত মোটামুটি হেসে খেলেই ফাইনালের টিকিটটা কেটেছে।
বুধবার (১৫ নভেম্বর) সেমিফাইনালে ভারত যেভাবে হেসে খেলে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে তাদের ফাইনালে যাওয়ার পথও ছিল একই রকম সহজ। দেখে নেওয়া যাক- যেভাবে ফাইনাল নিশ্চিত করল এবারের শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদাররা।
এবারের এই আসর শুরু হওয়ার পর থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল ১৯ তারিখের ফাইনালের একটি দল ভারত হবে। ভারতও আসরের শুরু থেকে সেভাবেই খেলে এসেছে।
টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই আগামীকালের ফাইনালের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েই দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ পুনরুদ্ধারের মিশন শুরু করেছিল টিম ইন্ডিয়া। টুর্নামেন্ট শুরুর তিন দিন পর চেন্নাইয়ে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামে স্বাগতিক ভারত। প্রথম ম্যাচেই সবাইকে মনে করিয়ে দেয় কেন তাদের শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদার ভাবা হচ্ছে? অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্ত প্রতিপক্ষকে ১৯৯ রানে অলআউট করে ম্যাচটি জিতে নেয় ৬ উইকেটে। তবে ম্যাচ জয়ের চেয়ে এই ম্যাচ থেকে ভারতের সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল দুই রানে তিন উইকেট হারানোর পর লোকেশ রাহুল ও বিরাট কোহলির চাপ সামলে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাওয়া।
অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর দুইদিন পর ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল আফগানিস্তান। দিল্লির ওই ম্যাচেও অনায়াসে জয় পেয়েছে বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মারা। প্রথমে টস জিতে ব্যাটিং করা আফগানদের ২৭২ রানে থামিয়ে দেয় ভারতের বোলাররা। ২৭৩ রান তাড়ায় অধিনায়ক রোহিত শর্মার ৮৪ বলে দুর্দান্ত ১৩১ রানে ৩৫ ওভারের মধ্যেই জয় তুলে নেয় ভারত।
ভারতের তৃতীয় ম্যাচ ছিল তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে। আগামীকালের ফাইনালের ভেন্যুতেই হওয়া সেই ম্যাচে টস জিতে পাকিস্তানকে ব্যাটিংয়ে পাঠান ভারত দলপতি রোহিত শর্মা। তারপরের কাজটুকু সম্পন্ন করেন ভারতের বোলাররা। ভারতের পাঁচ বোলারই দুই উইকেট করে নিয়ে পাকিস্তানকে আটকে ফেলে মাত্র ১৯১ রানে। আর আগের ম্যাচের মতই এই ম্যাচেও রোহিত শর্মার বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে সহজেই লক্ষ্যে পৌঁছায় ভারত।
রোহিতরা চতুর্থ ম্যাচে নামে পুনেতে। প্রতিপক্ষ ছিল এশিয়ার আরেক দেশ বাংলাদেশ। ক্রিকেটের উঠতি এই শক্তির বিরুদ্ধে টস হেরে বোলিং নিয়ে খুব একটা অখুশী ছিলেন না ভারত দলপতি। বাংলার টাইগারদের দেওয়া ২৫৭ রানের লক্ষ্য ভারতের সেরা ব্যাটার বিরাট কোহলির করা ৯৭ বলে অপরাজিত ১০৩ রানে সহজেই পেরিয়ে যায় টিম ইন্ডিয়া ।
পঞ্চম ম্যাচের জন্য ভারত যাত্রা করে নয়নাভিরাম হিমাচল প্রদেশে। হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় তাদের প্রতিপক্ষ ছিল তখন পর্যন্ত আসরের আরেকটি অপরাজিত দল নিউজিল্যান্ড। কিউইদের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে এই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো নামেন আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি মোহাম্মদ শামি। নেমেই তিনি প্রমাণ করেন ভারত তাকে বসিয়ে রেখে কি ভুলটাই না করছিল?
শামির বিধ্বংসী বোলিংয়ে মাত্র ২৭৩ রানেই গুটিয়ে যায় কিউইরা। রান তাড়ায় নেমে আবারও উড়ন্ত শুরু এনে দেন রোহিত শর্মা। তার ৪৬ ও বিরাট কোহলির ৯৫ রানে ৪৮ ওভারেই ২৭৪ রানের টার্গেট স্পর্শ করে ভারত।
ষষ্ঠ ম্যাচে ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। এই ম্যাচে এসেই ভারত সর্বপ্রথম ব্যাটিংয়ে চাপে পড়ে। ইংল্যান্ডের বোলারদের সুইং আর পেসে ২২৯ রানের থামে রোহিত শর্মাদের ইনিংস। এত অল্পরান তাড়ায় ভাবা হচ্ছিল প্রথমবারের মতো সম্ভবত ম্যাচ হারতে যাচ্ছে টিম ইন্ডিয়া। তবে বুমরাহ ও শামিদের ছিল অন্য পরিকল্পনা। শামির ৪ ও বুমরার ৩ উইকেটে মাত্র ১২৯ রানে গুটিয়ে যায় ইংলিশরা।
ভারত সবগুলো ম্যাচে জয় পাচ্ছিল ঠিকই তবে ওইভাবে বিধ্বংসী রূপ দেখা যাচ্ছিল না। ভারতের ওই রূপ দেখা গেল সপ্তম ম্যাচে। এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলংকার বিপক্ষে মুম্বাইয়ে প্রথমে ব্যাটিং করে শুভমান গিল, বিরাট কোহলি ও শ্রেয়াস আইয়ারের শতকের কাছাকাছি ইনিংসে ৮ উইকেটে ৩৫৭ রান করে ভারত। ব্যাটাররা এত বড় স্কোর এনে দেওয়ার পর খেলা দেখায় ভারতের বোলাররা। সিরাজ, শামি ও বুমরার বিধ্বংশী বোলিংয়ে মাত্র ৫৫ রানে গুটিয়ে যায় শ্রীলংকা। ৩০২ রানের এই বড় জয়ে সবার আগে সেমিফাইনালে নিশ্চিত করে টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু তখনো পয়েন্ট টেবিলের প্রথম স্থানটি পাকাপোক্ত হয়নি ভারতের। প্রথম স্থানটি পাকাপোক্ত করার জন্য দরকার ছিল দ্বিতীয় স্থানে থাকা দল দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো।
কলকাতায় নিজেদের অষ্টম ম্যাচে সেই কাজটি করে দেখাল ভারত। বিখ্যাত ইডেন গার্ডেন্স স্টেডিয়ামে কোহলির রেকর্ড ছোঁয়া ৪৯তম শতকে ৩২৬ রানের বড় স্কোর করে ভারত। জবাবে রবীন্দ্র জাদেজার স্পিন জাদুতে মাত্র ৮৩ রানেই অল আউট হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। আর এতেই পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ থেকে সেমিফাইনাল যাওয়া নিশ্চিত করে টিম ইন্ডিয়া।
নিজেদের নবম ম্যাচে ভারত মুখোমুখি হয় ১২ বছর পর বিশ্বকাপে আসা নেদারল্যান্ডসের সাথে। প্রথমে ব্যাটিং করে আইয়ার ও রাহুলের দুর্দান্ত শতকে ৪১০ রানের বড় স্কোর করে ভারত। যার জবাব স্বাভাবিকভাবেই নেদারল্যান্ডের কাছে ছিল না। মাত্র ২৫০ রানে নেদারল্যান্ডস অলআউট হলে ১৬০ রানের বড় জয় দিয়ে অপরাজিত থেকেই গ্রুপ পর্ব শেষ করে ভারত।
এবার পালা সেমি ফাইনালের। প্রতিপক্ষ সেই নিউজিল্যান্ড যাদের কাছে ২০১৯ সালের আসরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ভারতের। এবার অবশ্য তা হতে দেয়নি রোহিত শর্মার দল। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে টস জিতে ব্যাটিং নিয়ে বিরাট কোহলির রেকর্ড ৫০তম শতক ও শ্রেয়াস আইয়ারের দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিতে ৩৯৭ রানের বড় স্কোর করে মেন ইন ব্লুরা। জবাবে এক সময়ে লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়েও শামির দুর্দান্ত বোলিংয়ে ৩২৭ রানে থামে কিউইদের ইনিংস। শামির সাত উইকেটে নিশ্চিত হয় ভারতের জয়।
আগামীকাল দুপুরে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ২০০৩ সালের বদলা নেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের তৃতীয় শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শকের সামনে মাঠে নামবে টিম ইন্ডিয়া।
মন্তব্য করুন