ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যত বাড়ছে, ততই জটিল হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। বিশেষ করে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। কখনো তিনি ইসরায়েলি হামলার পক্ষে জোরাল অবস্থান নিয়েছেন, আবার কখনো নিজেকে সেই অবস্থান থেকে খানিকটা সরিয়ে নিয়েছেন। এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বপূর্ণ আচরণে তার কৌশল নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
সম্প্রতি ইসরায়েল তেহরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দেন, ইরানের বিরুদ্ধে আরও ভয়ঙ্কর হামলা আসতে পারে, যার পেছনে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইরান কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে পারবে না।
ট্রাম্পের এই বক্তব্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অবস্থানের সঙ্গে মিল থাকলেও ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি চান যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি চুক্তি হোক। এটাই তার পছন্দের পথ। তবে চুক্তির পথে যেতে গিয়ে তিনি কখনো কূটনৈতিক উদ্যোগের কথা বলেন, কখনো আবার শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিচ্ছেন।
তার এই অবস্থানকে অনেক সমর্থক ‘ম্যাড ম্যান থিওরি’ বা ‘পাগল তত্ত্ব’ বলে ব্যাখ্যা করছেন। ট্রাম্প অপ্রত্যাশিত ও অনিশ্চিত আচরণ করছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কোন পথে এগোবেন। তবে সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে- ট্রাম্পের সামনে আসলে এখন ৩টি পথ খোলা আছে।
১. নেতানিয়াহুর চাপ মেনে সংঘাত বাড়ানো
গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েল তেহরানে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে ট্রাম্প সতর্ক করেন, এর চেয়েও শক্তিশালী হামলা আসতে পারে এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রই ব্যবহৃত হবে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সুরে সুর মিলিয়ে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ইরানকে কোনোভাবেই পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জন করতে দেওয়া যাবে না।
তবে ট্রাম্প একই সঙ্গে দাবি করেন, তার প্রিয় সমাধান হচ্ছে ওয়াশিংটন‑তেহরানের মধ্যে নতুন চুক্তি, যদিও সেখানে পৌঁছাতে কখনো হুমকি, কখনো কূটনীতির খোঁজে দ্বিধায় ঘুরপাক খাচ্ছেন। এই দ্বৈত বার্তাকে তার ঘনিষ্ঠ মহল ‘ম্যাড‑ম্যান থিওরি’- ইচ্ছাকৃত অনিশ্চয়তা রেখে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার পুরোনো নিক্সনীয় কৌশল বলে বর্ণনা করছে। ইসরায়েল ও কংগ্রেসের রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা অবশ্য সামরিক বিকল্পকেই এগিয়ে নিচ্ছেন। তাদের বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাংকার‑ব্লাস্টার’ বোমা ফরদোর গোপন ইউরেনিয়াম স্থাপনা ধ্বংস করতে পারবে। যদি ইসরায়েলপন্থি কংগ্রেস সদস্যদের চাপ বাড়তেই থাকে, ট্রাম্পকে হয়তো শেষমেশ সামরিক পথেই হাঁটতে হতে পারে।
২. সীমিত সহযোগিতা ও মধ্যপন্থা
গণমাধ্যমের সামনে ট্রাম্প বারবার বলেছেন, ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িত নয়। বাস্তবে, মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ও ক্ষেপণাস্ত্র‑প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের পাল্টা আঘাত ঠেকাতে ইসরায়েলকে সহায়তা করছে- যার কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ইতিমধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা বলয় ভেদ করেছে।
হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের একাংশ ট্রাম্পকে সতর্ক করেছে, অতিরিক্ত উসকানি যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে আনতে পারে। সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে নেতানিয়াহু বলেছেন, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ওপর হামলাই যুদ্ধ শেষ করবে; তবে ট্রাম্প এটি নাকচ করে দিয়েছেন বলে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে।
৩. ঘরোয়া রাজনৈতিক চাপ ও পিছু হটা
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে রিপাবলিকান পার্টি এখন দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে কংগ্রেসের মূলধারা ইসরায়েলের জন্য অস্ত্র সহায়তা অব্যাহত রাখতে চায়, অন্যদিকে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ প্ল্যাটফর্মের প্রভাবশালী মুখগুলো- যেমন টাকার কার্লসন ও মার্জোরি টেলর গ্রিন প্রশ্ন তুলছেন, কেন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি নেওয়া হবে?
এই ভেতরের চাপ ট্রাম্পকে আক্রমণাত্মক কৌশল থেকে সরে গিয়ে সীমিত সম্পৃক্ততার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। সামনের দিনগুলোয় তিনি কোন পথ বেছে নেবেন- সংঘাত বাড়ানোর, মধ্যপন্থা বজায় রাখার, নাকি ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসার, তা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমীকরণই নয় বরং আগামীর মার্কিন রাজনীতির গতিপথও নির্ধারণ করতে পারে।
মন্তব্য করুন