বিশ্বজুড়ে দ্রুত কমে আসা জন্মহার এখন আর ভবিষ্যতের শঙ্কা নয়, বরং এক বাস্তব সংকট। সম্প্রতি বিবিসির একটি প্রতিবেদনে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল ইউএনএফপিএর বরাতে বলা হয়, ১৪টি দেশে করা এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের পাঁচজনের একজন জানিয়েছেন- তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তান নিতে পারছেন না বা পারবেন না।
এই সংকট বৈশ্বিক হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তা এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইউএনএফপিএর নির্বাহী পরিচালক ডা. নাতালিয়া কানেম জানান, পৃথিবীর ধনী-দরিদ্র, উন্নত-উন্নয়নশীল, ধর্মনিরপেক্ষ-ধর্মীয়- সব ধরনের সমাজেই জন্মহার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান নীরব পরিবর্তন যেন এক মৌন বিপ্লব, যার অভিঘাত বহু গভীর ও বিস্তৃত।
সমীক্ষকরা জানান, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, মধ্যপ্রাচ্যে নারীরা গড়ে সাতটি সন্তানের জন্ম দিতেন। অথচ ২০১০-এর দশকে এসে সে সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র তিনে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, আরব লীগের ২২টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তত পাঁচটির জন্মহার ২০২৩ সালে ২.১-এর নিচে, যা একটি জাতির টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ‘প্রতিস্থাপন হার’-এর চেয়েও কম। সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্মহার মাত্র ১.২, যা ইউরোপীয় নিম্নজন্মহারভুক্ত দেশ জার্মানির থেকেও কম।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জন্মহার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। গবেষকরা একে বলছেন, ‘গত ৩০ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জন্মহার পতনের ঘটনা।’
এই পরিবর্তনকে ‘নীরব বিপ্লব’ বলা হচ্ছে, কারণ এটি কোনো রাজনৈতিক স্লোগান, রাস্তায় বিক্ষোভ কিংবা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ঘটেনি। বরং মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে নীরবে, নির্জনে এ পরিবর্তন ঘটছে। তবে এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত বিস্তৃত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, ভর্তুকি প্রত্যাহার এবং সরকারি চাকরির অভাব-সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তরুণ প্রজন্ম পরিবার গঠনে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূলতা এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আরও অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিচ্ছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্সিয়া ইনহর্ন এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছেন ‘ওয়েটহুড’, অর্থাৎ ‘প্রতীক্ষার যুগ’ হিসেবে। তার মতে, বিয়ের আগে সোনার গহনা, নগদ অর্থ ও বাড়ি দেওয়ার সামাজিক প্রথা অনেক যুবককে আর্থিকভাবে অক্ষম করে তোলে, ফলে তারা বিবাহ বিলম্বিত করে।
তিনি বলেন, অপরদিকে অনেক নারীও সঠিক সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করছেন বা নিজের পেশাগত জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সবমিলিয়ে এটি সমাজে একটি নীরব সংকট তৈরি করছে।
জন্মহার কমার প্রবণতা মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত বয়ে আনছে। জন্মহার যখন প্রতিস্থাপন হারের নিচে নেমে যায়, তখন বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যায়। ফলে অর্থনৈতিক চাপ বাড়ে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা ও পেনশন ব্যয় বহনের ক্ষেত্রে। আর পশ্চিমা দেশের মতো সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা যেসব রাষ্ট্রে নেই, তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
জন্মহার পতনের পেছনে নারী শিক্ষার বিস্তার ও নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এখানেই শুরু হচ্ছে এক মৌলিক দ্বন্দ্ব- নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে জনসংখ্যা সংকোচনের বিষয়টি আজ আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের সামনে এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নীরব বিপ্লব হয়তো কোনো ব্যালট কিংবা ব্যারিকেডের রূপ নিচ্ছে না, কিন্তু তা মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বের ভবিষ্যতের গঠনে মৌলিক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই।
সূত্র : ডয়চে ভেলে
মন্তব্য করুন