ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত হামলায় হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। নারী ও শিশুদের লাশ প্রতিদিন নতুন করে যুক্ত হচ্ছে মৃত্যুর তালিকায়। জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশন সামনে চলে আসায় আবারও প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে—জাতিসংঘ কি গাজায় কিছু করতে পারছে না, নাকি করতে চাইছে না? কেন এত নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলার পরও আন্তর্জাতিক সংস্থাটি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না?
১৯৫৬ সালের অভিজ্ঞতা ও জাতিসংঘের ভূমিকা
১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল– সংকটের সময় প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সশস্ত্র শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করেছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল মিলে মিসর আক্রমণ করায় সেই সময়ে জাতিসংঘের ‘জরুরি বাহিনী’ সিনাই উপদ্বীপ ও গাজায় পাঠানো হয়। এ পদক্ষেপে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল, যদিও নিরাপত্তা পরিষদ তখনও অচল হয়ে পড়েছিল। কারণ আক্রমণকারী দেশগুলোর মধ্যে দুটো—ব্রিটেন ও ফ্রান্স—ভেটো ক্ষমতাধারী ছিল। তখন সাধারণ পরিষদ ১৯৫০ সালের ‘ইউনাইটিং ফর পিস’ প্রস্তাব ব্যবহার করে সমাধান বের করেছিল।
সেই সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেনহাওয়ার ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইসরায়েল জোটের মিসর আক্রমণের বিরোধিতা করেছিলেন। শক্তিশালী মহাসচিব দ্যাগ হ্যামারশোল্ডও জোটভুক্ত নয়, এমন দেশগুলোকে শান্তিরক্ষী পাঠাতে রাজি করিয়েছিলেন। মিসরও তা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিল। ফলে সংকট নিরসনে জাতিসংঘকে কার্যকর মনে হয়েছিল।
বর্তমান গাজা পরিস্থিতি
এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই ইসরায়েলের গাজা দখল অভিযানে সমর্থন দিচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অন্তত ছয়বার ভেটো দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আটকে দিয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবারও যুক্তরাষ্ট্রের কারণে গাজার জন্য মানবিক সহায়তার পথ খোলার প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। অর্থাৎ, নিরাপত্তা পরিষদ কার্যত অচল।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক সর্বোচ্চ তদন্ত সংস্থা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, গাজায় ইসরায়েল জাতিগত নিধন চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘের হাতে নিজস্ব সেনাবাহিনী নেই। ফলে বড় শক্তিধর দেশগুলো যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না দেখায়, সংস্থাটির ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে।
জাতিগত নিধনে জাতিসংঘের ব্যর্থতা
গাজা একমাত্র উদাহরণ নয়। রুয়ান্ডা ও বসনিয়ায় ভয়াবহ গণহত্যার সময়ও জাতিসংঘ কার্যত অসহায় প্রমাণিত হয়েছিল। রুয়ান্ডায় শান্তিরক্ষী মিশনের কমান্ডার রোমিও ড্যালেয়ার বারবার সতর্ক করেছিলেন, ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ আসছে। কিন্তু জাতিসংঘ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বসনিয়ার স্রেব্রেনিৎসায় হাজারো মুসলমান হত্যার আগেও জাতিসংঘ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, কিন্তু তাতেও হত্যাযজ্ঞ ঠেকানো যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘ তখনই কার্যকর হয়, যখন বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখায়। কিন্তু গাজার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কেবল ইসরায়েলকে সমর্থনই দিচ্ছে না, বরং জাতিসংঘের পদক্ষেপ ঠেকাতেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্টিন শ বলেছেন, গাজার গণহত্যাকে আধুনিক ইতিহাসের অন্য জাতিগত নিধনের থেকে আলাদা করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা। শুধু নীরব সমর্থন নয়, বরং অস্ত্র, অর্থ ও রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখানে কার্যত অংশীদারের ভূমিকা পালন করছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাটো ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো ডাগ ব্যান্ডো স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতার দায় জাতিসংঘের নয়; বরং ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের।’ তার মতে, জাতিসংঘ একা কিছুই করতে পারবে না, কারণ তাদের নিজস্ব বাহিনী নেই।
বিভক্ত সাধারণ পরিষদ
বর্তমানে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদও বিভক্ত। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ভেটো কার্যত কোনো সমাধানকে আটকে দিচ্ছে। যদিও ইতিহাস বলছে, সাধারণ পরিষদ চাইলে নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটাতে পারে। কিন্তু গাজা ইস্যুতে এখনো কার্যকর কোনো প্রস্তাব তোলা হয়নি। ফ্রান্স ও সৌদি আরব এবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইতিহাসের শিক্ষা
ইতিহাস বলছে, মহাশক্তিধর দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া জাতিসংঘ একা কোনো জাতিগত নিধন ঠেকাতে সক্ষম নয়। দারফুরের ক্ষেত্রেও তা দেখা গিয়েছিল। সুদান সরকারের মদদপুষ্ট মিলিশিয়াদের হাতে যখন মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে তা জাতিগত নিধন হিসেবে স্বীকার করলেও পরে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। আফ্রিকান ইউনিয়ন সীমিত শান্তিরক্ষী পাঠিয়েছিল, জাতিসংঘও দেরি করেছিল।
পরিশেষে
গাজায় ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। শহরটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অথচ জাতিসংঘ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এর মূল কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো, ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন এবং বড় শক্তিধর দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
ফলে গাজা প্রশ্নে জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতা আবারও সামনে এসেছে। জাতিসংঘ একা নয়, বরং সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে, গাজায় জাতিগত নিধন বন্ধ হবে কি না।
মন্তব্য করুন