মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি। বর্তমানে যার সব সূচকই নেতিবাচক। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এতে বিনিয়োগ বাড়ানোর তেমন কার্যকর পদ্ধতি নেওয়া হয়নি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য—এ তিন ধরনের পণ্যকে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই এসব পণ্যের আমদানি কমাকে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্য বাধা হিসেবে দেখা হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান অর্থনৈতিক নানামুখী চাপের মধ্যে কেউ নতুন উৎপাদনে যাচ্ছেন না। আর এজন্যই মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৭ শতাংশ, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩১ দশমিক ২১ শতাংশ আর মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমেছে ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ।
সেইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত নভেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। যদিও মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর শেষে ঋণ প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে। এ সময় ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তার চেয়েও অনেক কম হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর জুন পর্যন্ত ধরা হয়েছে ১১ শতাংশ। প্রথমার্ধে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, এবারের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমানোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। তবে এখনকার মূল্যস্ফীতি মূলত সরবরাহজনিত। বিশেষ করে আমদানি খরচ বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে। ফলে সরবরাহ বাড়াতে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদনশীল খাতে ঋণ বাড়ানো উচিত। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমানোর ওপর জোর দেওয়া দরকার। তিনি বলেন, এমনিতেই ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র, মাঝারির চেয়ে বড়দের বেশি ঋণ দিতে চায়। ঋণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা কমানোয় এখন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা আরও বেশি ঋণবঞ্চিত হবেন। এ কারণে কর্মসংস্থান সৃষ্টিও বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। শুধু তাই নয়, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন না বাড়লে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে কী হবে। কর্মসংস্থান বেড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও সমস্যা নেই। এজন্য রপ্তানি আয়, ডলার ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর নতুন কৌশল সম্পর্কে কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া দরকার ছিল, যা মুদ্রানীতিতে একেবারেই অনুপস্থিত। কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্যও তেমন কোনো কৌশল দেখা যায়নি। এসব খাতে যদি কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন না বাড়ে তাহলে আমাদের আমদানি ব্যয় তো আরও বাড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে কী করে? কৃষি এবং এসএমই খাতের জন্য যে পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের কথা বলা হয়েছে, সেখানেও সমস্যা আছে। কেননা ব্যাংকাররা তো ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্য পুনঃঅর্থায়নে ঋণ দেওয়ার বিশেষ আগ্রহ দেখায় না।
বেসরকারি খাতে কাঙ্ক্ষিত হারে ঋণ প্রবৃদ্ধি না বাড়লে আগামী দিনে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। সেইসঙ্গে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার যে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেটাও বাস্তবায়ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য মোটেও স্বস্তিকর নয়। কারণ আমাদের দেশের মোট বিনিয়োগের অধিকাংশই আসে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নিয়ে। আর আমাদের পুঁজিবাজার এখনো সেভাবে বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মানেই হচ্ছে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। আর বিনিয়োগ কমে গেলে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান কমে যাবে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের যে লক্ষ্য রয়েছে, তাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুধু তাই নয়, বাজেটে সরকার যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তাও অর্জন হবে না।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হারের চাপ নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিতের বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে মুদ্রানীতিতে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমানোয় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে এখন আমাদের মাথাব্যথা নেই। মূল্যস্ফীতি কমানোই আমাদের মূল লক্ষ্য। এর জন্য যদি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমও হয়, তাহলে কিছু করার নেই। তার জন্য বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানো হয়েছে। তবে উৎপাদনশীল খাতের জন্য বিভিন্ন তহবিল চালু আছে স্বল্প সুদে। এজন্য সিএমএসএমই, এসএমই এবং কৃষির জন্য বেশ কয়েকটা রিফাইন্যান্স ও ট্রিফাইন্যান্স স্কিম বা বিশেষ পদ্ধতি চালু আছে। রপ্তানি উন্নয়নের জন্য এবং নারীদের জন্য আলাদা তহবিল করেছি। এসব তহবিলের ঋণের সুদহারও অনেক কম। প্রয়োজন হলে এসব তহবিলে ঋণ সুবিধা আরও বাড়ানো হবে। আর ব্যাংক যদি এসব খাতে ঋণ দিতে অনাগ্রহী হয়, তার জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টির সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে।