ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দীর্ঘদিন পর চীন সফর, দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক, নয়াদিল্লি-বেইজিংয়ের নতুন সম্পর্ক ভূরাজনীতিতে নতুন বার্তা দিচ্ছে। সম্প্রতি তিয়ানজিনে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে মোদি ছাড়াও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও অংশ নেন। তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত-চীনের নতুন সম্পর্ক বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ পাকিস্তানের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে?
ওই সফরে তিয়ানজিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য দেন মোদি। তার সঙ্গে বৈঠকের সময় শি জিনপিং বলেছিলেন, বিশ্বের পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। ভারত এবং চীন শুধু দুই প্রাচীন সভ্যতাই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে জনসংখ্যাবহুল দেশ এবং একই সঙ্গে গ্লোবাল সাউথের অংশও। তিনি বলেছিলেন, দুই দেশের জন্য ভালো বন্ধু হিসেবে থাকা এবং একে অপরের সাফল্যে অবদান রাখে—এমন অংশীদারত্ব গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কথায়, ‘ড্রাগন এবং হাতি একত্রিত হওয়া উচিত।’
একই সুর শোনা গেছে নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠেও। তিনি বলেছেন, ‘দুই দেশের সহযোগিতার সঙ্গে ২৮০ কোটি মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে ভারত বদ্ধপরিকর।’
দুই রাষ্ট্রনেতার এমন এক সময় সাক্ষাৎ হয়েছে, যখন ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শুল্ক ভারতের রপ্তানি খাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।
অতীতের সীমান্ত নিয়ে বিরোধের বদলে ভারত ও চীন তাদের সম্পর্ক পুনর্গঠনের ওপর জোর দিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউস’-এর ড. ক্ষিতিজ বাজপেয়ি বলেছেন, ‘বর্তমান সময়ে বিশ্বে কী কী পরিবর্তন ঘটছে—তার ওপর দুই দেশের সম্পর্ক নির্ভর করে।’ বেইজিংভিত্তিক ‘ওয়েইসওয়া অ্যাডভাইজরির’ প্রধান নির্বাহী চি-আন লিউ বলেন, ‘চীন ও আমেরিকার সম্পর্ককে বিশ্ব অনেকটাই গুরুত্ব দিয়েছে। এবার বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির (চীন ও ভারত) কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, সেটা দেখার সময় এসেছে।’ তবে ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সীমান্ত বিরোধ থাকার কারণে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পুতিনসহ প্রায় বিশ্বের বিভিন্ন নেতা এসসিও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এত কিছুর পরও ভারত ও পাকিস্তানের সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে যে, ওই দুই দেশের মধ্যে কে চীনের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। শাহবাজ শরিফের একটা ছবি মোদির এক্স হ্যান্ডেল থেকে পোস্ট করা হয়েছিল। ওই পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনে যোগ দেবেন এবং বেইজিংয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উদযাপনে অংশগ্রহণ করবেন।’ তিয়ানজিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘পাকিস্তান ও চীনের বন্ধুত্ব পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং প্রকৃত ভালোবাসার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। পাকিস্তান ও চীন সব কঠিন সময়ে একে অপরকে সমর্থন করেছে।’
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ আহমেদ চৌধুরী মনে করেন, ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক পাকিস্তানের ওপর প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, বেইজিংয়ের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী ও কৌশলগত।
চীনবিষয়ক পর্যবেক্ষক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. ফজলুর রহমান বিবিসিকে বলেন, ‘চীন ও পাকিস্তানের বন্ধুত্বকে কোনো বাইরের ফ্যাক্টর প্রভাবিত করতে পারবে না।’
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জোহর সলিম জানান, এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের টানাপোড়েন চলছে। এ আবহে ভারত দেখাতে চাইছে, তাদের কাছে বিকল্প হিসেবে অন্য দেশও রয়েছে।
তার মতে, ভারত ও চীনের মধ্যে কৌশলগত সংঘাত চলছে এবং তা ‘দীর্ঘ সময় ধরে চলবে’। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, ভারতের মধ্যে বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এই দৌড়ে চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে। অন্যদিকে, পাকিস্তান ও চীনের স্বার্থ একই বলে মনে করেন জোহর সেলিম।
মন্তব্য করুন