সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সুপার গ্রেড কার্যকর এবং স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে গত ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তবে এই আন্দোলন নিয়ে ফেডারেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (ডুটা) মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। এর পেছনে কারণ হিসেবে ডুটার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জিনাত হুদার কিছু আচরণকে দায়ী করছেন ফেডারেশনভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা। জিনাত হুদার ওপর ক্ষুব্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষকরাও।
শিক্ষকরা বলছেন, স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব পড়েছে আন্দোলনে। প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহারের আন্দোলনে শুরুর দিকের মতো চাঞ্চল্য নেই। রাজধানীর পাশাপাশি ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই আন্দোলনে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ কমছে। ধারাবাহিক এই আন্দোলনের পরবর্তী রূপ কী হবে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন শিক্ষকরা।
জানা গেছে, গত ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই এটিকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে সরব হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এই স্কিম প্রত্যাহারসহ তিন দাবিতে ২৫-২৭ জুন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাতেও দাবি আদায় না হওয়ায় ৩০ জুন পূর্ণ কর্মবিরতি পালন করা হয় এবং ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা, একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রেখেই শিক্ষকদের এই কর্মসূচি চলছে। এর ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষাসহ দাপ্তরিক সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
ঢাবি শিক্ষক সমিতির একটি সূত্র বলছে, এই আন্দোলন শুরুতে প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন বাতিলে একদফার আন্দোলন ছিল। কিন্তু শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা না করেই আরও দুটি দাবি যোগ করা হয়। কিন্তু স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও সুপার গ্রেডের বিষয়ে অনেকেরই আপত্তি ছিল। সূত্র বলছে, ফেডারেশনের সভায়ও জিনাত হুদাকে নিয়ে ঝামেলা হয়। কারণ, অন্য কারও মতামত তিনি নিতে পারেন না। এর ফলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক শিক্ষকই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
ফেডারেশনের একটি সূত্র বলছে, ফেডারেশনের সভায় জিনাত হুদা ঢাবিতে কী কী করেছেন, তার কী অবদান, কী কী সমস্যা—সেগুলো নিয়ে বেশি আলোচনা করেন। সে কারণে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মণ্ডল বলেছিলেন, এসব বিষয় নিয়ে ঢাবি শিক্ষক সমিতিতে আলাদা করে আলোচনা করে নেওয়া যায়। এটি বলার পরপরই ক্ষিপ্ত হন জিনাত হুদা। তিনি আসাদুজ্জামান মণ্ডলের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
সে সভায় উপস্থিত একজন শিক্ষক কালবেলাকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা কেন ফেডারেশনের সভায় আলোচনা করতে হবে? এর জন্য তো শিক্ষক সমিতি আছেই। কিন্তু তাকে কেউ এটা নিয়ে বললে তিনি ক্ষেপে যান। আসাদের সঙ্গেও তাই করেছেন। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরাও বলছেন, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো আন্দোলন করছে না। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তো ফেডারেশনের ডাকে আন্দোলন করছে। কিন্তু সেটি মানতে নারাজ জিনাত হুদা। বিষয়টি নিয়ে ফেডারেশনের মধ্যে এখনো অসন্তোষ বিরাজ করছে।
জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান মণ্ডল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তবে এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত একটি বিভাগের শিক্ষকরা দাবি করেছেন, শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচিতে এলেও তিনি (জিনাত হুদা) অনেককে বসতে দেন না। বক্তব্য দিতে দেন না। অনেকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেন। এমনকি নীল দলের আহ্বায়ককেও বক্তব্য দিতে দেন না। যে কারণে অনেক শিক্ষকই এখন অবস্থান কর্মসূচিতে আসেন না। তিনি বলেন, আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি বিষয়ে সমিতির সভা ডাকার আহ্বান জানিয়েছে সাধারণ শিক্ষকরা। তাতে সাড়া দেননি জিনাত হুদা। আবার ঢাবি উপাচার্যের সঙ্গে বসার কথা বললেও তারা সায় থাকে না। এসব কারণে শিক্ষকরাও আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান।
ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত একটি বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন, প্রথমে শিক্ষক সমিতি আন্দোলন করতে রাজি ছিল না। সে কারণে সমিতির কোনো সভা ডাকেননি। তবে নবীন শিক্ষকদের জোরাজুরিতে একপর্যায়ে তারা আন্দোলনে নামেন। তিনি বলেন, সামনের দিনগুলোতে শিক্ষকদের আন্দোলনের গতি পথ কী হবে, সেটি নির্ধারণের জন্য সাধারণ শিক্ষকরা সমিতির সভা ডেকে কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য বলেছেন। কিন্তু জিনাত হুদা জানিয়েছেন, আগে সরকারের সঙ্গে সভা হবে। এরপর সমিতির সভা হবে। ফলে শিক্ষকরা আন্দোলন নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন। যে কারণে শিক্ষকরাও সরাসরি বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দাবি আদায়ে তত বেশি সরব নন।
ফেডারেশনের একজন শিক্ষক নেতা কালবেলাকে বলেন, আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে সমিতির সভা ডাকতে হয়। সেখানে বিভিন্ন আলোচনা আসে, সে অনুযায়ী কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করার কোনো সিদ্ধান্ত সমিতি থেকে নেওয়া হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করেই জিনাত হুদা ঘোষণা দিলেন, শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে থাকবেন না। এই ঘোষণা দেওয়ায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করা শিক্ষকরাও খুবই অবাক হন। এই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক সমিতির মধ্যে আভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ছিল। এরপর ফেডারেশনের সভায় বিষয়টি উত্থাপিত হয়। সেখানে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ায় বাধা দেওয়া যায় না বলে একাধিক মতামত আসে। সে অনুযায়ী অনেক শিক্ষকই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে অংশ নেন। তিনি বলেন, সর্বাত্মক কর্মবিরতির অংশ হিসেবে সব জরুরি সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয়। অনেকেই বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। আবার শিক্ষক সমিতির কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই জিনাত হুদা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সার্ভিস বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেন। এতেও অনেকেই ক্ষিপ্ত হন।
তিনি আরও বলেন, অবস্থান কর্মসূচির সময় জিনাত হুদা ও তার স্বামী এবং বোনকে ফ্লোর দিলেও অনেক শিক্ষককে বসতে দেন না। এই বিষয়টি অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি এই আন্দোলনকে পারিবারিকীকরণের চেষ্টা করছেন। তার একক স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষকরা। তার স্বামী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বরাবর লংমার্চ করার কথা বলেছেন। আমাদের এই আন্দোলন তো সরকারের বিপক্ষে নয়। আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর দায় জিনাত ও তার স্বামীকেই নিতে হবে।
জানতে চাইলে অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, এসব অভিযোগ কারা উঠিয়েছে, তা আমি জানি না। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যাব না, সেটি উপাচার্যকেও জানিয়েছি। কিন্তু শিক্ষকদের যেতে না করিনি। ১ জুলাইয়ের বিষয়ে আমি এখনই মুখ খুলব না। আন্দোলন শেষ হলে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাব। আর বেরোবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গেও আমার কোনো কথা কাটাকাটি হয়নি। আন্দোলনকে স্যাবোটাইজ করার জন্যই এসব করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ফেডারেশন সিদ্ধান্ত নেয়, শিক্ষক সমিতিগুলো তাদের মতো করে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। জিনাত হুদা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির জন্য। এর সঙ্গে ফেডারেশনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আসাদুজ্জামান মণ্ডলের সঙ্গে তর্কাতর্কির বিষয়ে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সেখানে কী হয়েছে সেটা বলা যাবে না। তবে সভায় আমাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এই ঝগড়ার প্রভাব আন্দোলনে পড়বে না বলে জানান তিনি।