জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের পর আগে থেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মকর্তাদের চলমান আন্দোলন সামাল দিতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে ক্যাডারদের আপত্তিকর আচরণ-মন্তব্য এবং কমিশনপ্রধানের পদত্যাগের দাবিতে সম্মেলন করে আলটিমেটাম দেওয়ার বিষয়টিকে সরকার মোটেও ভালোভাবে নেয়নি। ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের’ ব্যানারে আন্দোলনকেও কর্মকর্তাদের বাড়াবাড়ি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ও কমিশনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে জমা দিয়েছে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এরই মধ্যে অন্তত একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য না এলেও তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সাম্প্রতিক বক্তব্যে তাদের কঠোর অবস্থানের বিষয়ে আভাস মিলেছে। গত শুক্রবার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে এক অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, যারা আন্দোলনের নামে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আমলাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, আমরা সাম্প্রতিক সময়ে আমলাদের বক্তব্য শুনতে পারছি। তারা এক ধরনের হুমকি দিচ্ছে। এটার সাহস তারা পেয়েছে বিগত সময়ে, সেই সময় দেখেছি আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করা হয়েছে। আমলাতন্ত্র নির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিজম তৈরি করা হয়েছে।
অভিযুক্ত আমলাদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে—ওই অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, এটা নিয়ে বৈঠক করেছি। আগামী সপ্তাহে কঠোর পদক্ষেপ আসবে। যারা আন্দোলনের নামে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করছে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং আমলাদের বলছি, এখন সময় জনগণকে সেবা দেওয়ার। গণতান্ত্রিক ট্রানজিকশনটা সঠিকভাবে করার সহযোগিতা করার। আন্দোলন আন্দোলন খেলা কিংবা গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষার জন্য এত মানুষ জীবন দেয় নাই।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে কর্মকর্তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, রাষ্ট্রের সংস্কার হলে সবাই ন্যায়বিচার পাবেন। সংস্কারে তাদেরও মত থাকবে, তাদের কথা শোনা হবে। সংস্কার সুপারিশে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এটা তাদের নৈতিকভাবে ঠিক হয়নি। তারা বিধিগতভাবেও লঙ্ঘন করেছে। বিগত সরকার আমলের আমলারা নানাভাবে লুকিয়ে আছে, তাদের চিহ্নিত করেছি। তাদের বিরুদ্ধেও দ্রুত ব্যবস্থা নেব।
দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশ নিয়ে অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ) এবং বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড। গত ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীতে সংগঠন দুটির যৌথ প্রতিবাদ সভা থেকে কমিশনপ্রধানের পদত্যাগে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম ও কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা আসে। এমন ঘোষণাকে সরকার ও কমিশনের প্রতি ‘অসম্মান’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ প্রবণতা ঠেকিয়ে জনপ্রশাসনকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে আন্দোলনের নেপথ্যে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চায় সরকার। এজন্য ২৫ ডিসেম্বরের সভায় জ্বালাময়ী বক্তব্য দেওয়া কর্মকর্তাদের অতীত কর্মকাণ্ডের খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া কালবেলাকে বলেন, প্রয়োজনে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কঠোর বার্তা দিতে হবে। আমলাদের বলতে হবে যেন তারা আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে জনসেবায় মন দেয়। কারণ তাদের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে জনসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। এমনিতে প্রশাসনে ভালো কর্মকর্তার সংকট। মানুষ ঠিকমতো সেবা পায় না। সুতরাং কর্মকর্তারা যেন নিজেদের সুযোগ-সুবিধার দাবি আদায় বাদ দিয়ে কাজে ফেরেন, সে বার্তা দিতে হবে। তাদের চাকরিবিধির বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।
তবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে ফিরোজ মিয়া বলেন, এখনই ঢালাওভাবে চাকরিচ্যুতি কিংবা অন্য কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়া ঠিক হবে না। তাহলে প্রশাসন ঠিকমতো ফাংশন করবে না।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসেছে যাদের নাম: সরকারের কাছে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার জমা দেওয়া প্রতিবেদনে আমলাদের আন্দোলনে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাসহ বর্তমান চারজন কর্মকর্তার বক্তব্য ও ফেসবুক পোস্টকে বিশেষভাবে আমলে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে চাকরিতে থাকা ওই চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এই চার কর্মকর্তা হলেন বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলার ডিসি, প্রভাবশালী একজন উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস), গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একজন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিআরইবির একজন যুগ্ম সচিব।
২৫ ডিসেম্বরের সমাবেশে অভিযুক্ত ডিসি রীতিমতো জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ডিসিদের থেকে এসপিদের এসিআর সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারকে দুর্বল করা হয়েছে। সিভিল প্রশাসনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আগের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
অভিযুক্ত পিএস সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, জনগণের সেবাকে আরও সহজ না করে আপনারা এসেছেন ভাগবাটোয়ারা করতে। অ্যাডমিন সার্ভিসের জন্য আলাদা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস করতে হবে।
এদিকে সাদিকুর রহমান সবুজ নামে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অভিযুক্ত আঞ্চলিক কর্মকর্তা তার ফেসবুক পোস্টে আপত্তিকর ভাষায় কিছু মন্তব্য করেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তার এ বক্তব্য নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটেছে।
বিআরইবির অভিযুক্ত যুগ্মসচিবও ফেসবুকে লিখেছেন, রাস্তায় যখন নেমেছি অধিকার আদায় ছাড়া ঘরে ফিরছি না। রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না ইনশাআল্লাহ।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আন্দোলনে উসকানি ছড়ানোর অভিযোগ ওঠা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংস্কার কমিশনের প্রধানকে বিতর্কিত বলে অভিহিত করেন এবং তার অপসারণের জন্য আলটিমেটাম দেন।
যেসব শাস্তি পাচ্ছেন দোষীরা: সূত্র বলছে, আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়া ডিসিকে দ্রুতই তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। আর গাজীপুর সিটির আঞ্চলিক কর্মকর্তা সাদিকুর রহমান সজীবকে গতকাল সোমবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তের আদেশে বলা হয়েছে, ওএসডি থাকা সাদিকুর রহমানের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩(খ) অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য তাকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালে তিনি বিধি অনুযায়ী খোরপোশ ভাতা পাবেন।
ওই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের জন্য এরই মধ্যে তার বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এদিকে কর্মকর্তাদের আন্দোলনে উসকানি দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত যেসব কর্মকর্তা নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আবেদন করেছেন, তাদের আর বিবেচনায় নেওয়া হবে না। এমনকি যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল—এমন কর্মকর্তারাও আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন না, এর মধ্যে দুজনের সচিব পদে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
কর্মকর্তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া: সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে স্বনামে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি কোনো কর্মকর্তা। একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, একদিকে দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে সক্রিয় কর্মকর্তারা, অন্যদিকে সচিবালয়ে আগুনের ঘটনা। এসব বিষয় নিয়ে আমলাদের ওপর চরম বিরক্ত সরকারের নীতিনির্ধারকরা। ফলে সামনের দিকে দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের পর আমলারা ভীষণ চাপে আছে বলেও মনে করছেন অনেকে।
এদিকে কর্মকর্তাদের সম্মেলন থেকে আগামী ৪ জানুয়ারি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মহাসমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছিল। গত রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানিয়েছেন, ওইদিন তাদের কোনো কর্মসূচি নেই।
এমন বিজ্ঞপ্তি দেওয়াকে আন্দোলনরতদের পিছিয়ে পড়ার নজির হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রকাশ্যে সরকার ও জনপ্রশাসন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করার পর থেকে আমলারা নানা চাপে আছেন। সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের পর তাদের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। খো
এমন পরিস্থিতিতেও ফুরফুরে মেজাজে আছেন কয়েকটি ব্যাচের কর্মকর্তারা। কারণ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ হলে প্রশাসন ক্যাডারের ১৫ ও ১৭ ব্যাচ থেকে বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা সচিব হওয়ার সুযোগ পাবেন।