যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্কারোপ নিয়ে সারা বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের ওপর বাড়তি ২২ শতাংশ, অর্থাৎ ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও। এমন পরিস্থিতিতে সমঝোতাকে বিকল্প হিসেবে দেখছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। কারণ বাংলাদেশে রপ্তানি হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা বর্তমান রয়েছে। এর বাইরে বেশি আমদানি হয়ে থাকে রড তৈরির মূলধনী কাঁচামাল স্ক্র্যাপ। এক্ষেত্রেও শুল্কহার মাত্র ৩ ডলার। সব মিলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করা গেলে বাড়তি শুল্কের বোঝা থেকে পোশাক খাত রক্ষা পেতে পারে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আগামীকাল রোববার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকের সিদ্ধান্তও হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। শীর্ষ দশ রপ্তানিকারকের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বাজার। তবে সবচেয়ে বড় বিষয়, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে যেসব পণ্য রপ্তানি করে, তার বেশিরভাগ কাঁচামাল সেই দেশটি থেকে আসে। আর এসব পণ্য দেশের বর্তমান নিয়মে শুল্ক সুবিধা পেয়ে আসছে। এ ছাড়া আসে সয়াবিন বীজ ও তুলা। এই দুই পণ্যেও রয়েছে শুল্কমুক্ত সুবিধা। এর বাইরে বেশি পরিমাণে আসে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ। এতে মাত্র তিন ডলার হিসেবে শুল্কায়ন হচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকটি পণ্য ছাড়া বাংলাদেশে আমদানি হওয়া বেশিরভাগ পণ্যে রয়েছে শুল্ক সুবিধা। তাই বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় যেতে হবে বলেও মনে করেন তারা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসও আলোচনার মাধ্যমে ইতিবাচক সমাধান আসবে বলে জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার মেনুফ্যাকচারার এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালবেলাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্ব মোড়ল। যেহেতু আমরা তাদের মতো শক্তিশালী না, তাই আমাদের সমঝোতার পথে যেতে হবে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমরা তুলা আমদানি করে সুতা তৈরি করি এবং সুতার তৈরি কাপড় যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করি। মার্কিন সুতা আমদানিতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না। এ ছাড়া শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি হওয়া মার্কিন পণ্যেও রয়েছে শুল্ক সুবিধা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া বেশিরভাগ পণ্যে শুল্ক সুবিধা দেওয়া আছে। বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ইউনূস বিষয়গুলো ভালোভাবে সমাধান করতে পারবেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকার থেকে শুরু করে সারা বিশ্বে তার আলাদা ইমেজ রয়েছে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার শুল্কের হার কমাতে চায়। বর্তমানে তারা ৭৪ শতাংশ কর দিচ্ছে। এটা ৪০ শতাংশে নামিয়ে আনলে তা আমাদের রপ্তানিকারকদের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করার ফলে ভলিউম বাড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবধান কমবে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র সরকার শুল্ক কমানোর আহ্বান জানিয়েছে, তাই বাংলাদেশকে নীতিগত সংস্কার আনতে হবে।
দেশের উদ্যোক্তা ও সরকারি সংস্থার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাংলাদেশের অনুকূলে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি আমদানির চেয়ে অনেক বেশি। রপ্তানি তৈরি পোশাকের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল, যার মধ্যে বেশিরভাগ মৌলিক আইটেম। অন্যদিকে, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি লোহা, ইস্পাত, খনিজ জ্বালানি, তুলা, তেলবীজ ও নিউক্লিয়ার রেক্টরসহ পাঁচটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ১০ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৭ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার এবং দেশ থেকে আমদানি ছিল ২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র সরকার শুল্কের হার কমাতে চায়। বর্তমানে তারা ৭৪ শতাংশ কর দিচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬০১ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ইস্পাত, ৫৯৫ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের খনিজ জ্বালানি, ৩৬১ মিলিয়ন ডলারের তুলা, ৩৪১ মিলিয়ন ডলারের তেলবীজ ও ১১১ মিলিয়ন ডলারের নিউক্লিয়ার রেক্টর আমদানি করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান কালবেলাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে বেশি আসে সয়বিন বীজ, তুলা এবং স্ক্র্যাপ। তুলা এবং সয়াবিন বীজ শুল্ক ফ্রি। আর স্ক্র্যাপ শুল্কায়ন হয় টন হিসেবে। সে হিসাবে স্ক্র্যাপে শুল্ক আছে মাত্র ৩ ডলার। এ ছাড়া আমাদের কান্ট্রি বেসিস কোনো ধরনের শুল্কায়ন রেটও নেই। তবুও আমরা তথ্য-উপাত্তগুলো সংগ্রহ করছি। সেগুলো বিশ্লেষণ করছি। যুক্তরাষ্ট্র যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে, তার ভিত্তি কী, কীভাবে কী করা যায়, এ ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে যা যা করণীয় আমরা তা করব। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেসব পণ্যের কথা বলছে, সেগুলোর শুল্ক শূন্যের কোঠায়ই আছে। আমরা এগুলো দেখছি। আর দেশের স্বার্থে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেশিরভাগ আসে তৈরি পোশাক থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের ৭ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। বাকিটা এসেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, চামড়ার জুতা, ফার্মাসিউটিক্যালস ও বিভিন্ন কৃষিপণ্য থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ছিল ৯ হাজার ৭০১ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৩৪৪ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ১ হাজার ৪১৭ দশমিক ৭২ মিলিয়ন এবং আমদানি হয় ২ হাজার ৮২৫ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৬ হাজার ৯৭৪ দশমিক শূন্য ১ মিলিয়ন ডলারের এবং আমদানি হয়েছে ২ হাজার ২৬৮ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি ছিল ৫ হাজার ৮৩২ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলার এবং আমদানি হয়েছে ২ হাজার ১২৬ দশমিক ১০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন নতুন করে যে শুল্ক আরোপ করেছে, সরকার তা পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ঈদের ছুটি থাকায় গত বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক বৈঠক করা সম্ভব হয়নি। ঈদের ছুটি শেষে আগামীকাল রোববার থেকে অফিস শুরু হবে। অফিস শুরুর দিনেই এই শুল্ক নিয়ে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন। বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, এনবিআরের চেয়ারম্যান, অর্থ সচিব, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে যে শুল্ক আরোপ করেছে তা উদ্বেগের বিষয়। এ কারণে বিষয়টি পর্যালোচনা করতে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে।
মন্তব্য করুন