মশার অসহনীয় যন্ত্রণায় বছরের পর বছর ধরে ভুগছে রাজধানীর মানুষ। এর মধ্যে ভয়ংকররূপে দেখা দিয়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর। চলতি বছর এ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। অট্টালিকা কিংবা বস্তিঘর—কোথাও মশার যন্ত্রণা থেকে নিস্তার মিলছে না নগরবাসীর। প্রতিবছর সিটি করপোরেশনের বাজেট বাড়লেও তার সুফল মিলছে না। মূলত পদ্ধতিগত ভুলের কারণেই মশা নিধন কার্যক্রমের সুফল মিলছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সেইসঙ্গে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সমন্বয়হীনতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী উদ্যোগের কারণে এবার এ সংকট তীব্র হয়েছে বলে তাদের মত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে ভোরে লার্ভিসাইডিং (লার্ভা নিধনকারী ওষুধ স্প্রে) ও সন্ধ্যার আগে অ্যাডাল্টিসাইডিংয়ের (উড়ন্ত মশা মারতে ফগিং) মাধ্যমে ঢাকায় মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে; কিন্তু এ পদ্ধতিতে সফল হয়নি দুই সিটি করপোরেশন। সর্বশেষ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাকটেরিয়া আমদানি করে। তবে আমদানিতে জাল-জালিয়াতির বিষয়টি সামনে আসার পর বিটিআই প্রয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে।
মূলত মশা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘকাল ধরে শুধু ধোঁয়া ছড়ানোর (ফগিং) ওপর নির্ভরশীল ছিল দুই সিটি করপোরেশন; কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা এ পদ্ধতি কতটা কার্যকর—বিশেষজ্ঞরা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও মশক বিশেষজ্ঞ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সিটি করপোরেশন কখনোই আন্তরিকভাবে মশা মারার চেষ্টা করেনি। তাদের বছরব্যাপী একটি সার্ভিল্যান্স সিস্টেম থাকা দরকার। প্রতি মাসে জরিপ থাকলে মশার ঘনত্ব বোঝা যায়। তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া যায়। আমাদের এখানে বছরে তিনটি সার্ভে হয়। ফলে সিটি করপোরেশনও বাস্তব চিত্র বুঝতে পারে না। আবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কেবল রোগীর একটি সংখ্যা দেয়; কিন্তু রোগী কোন এলাকার, কত বয়সের, ডেঙ্গুর স্ট্রেন কী—এসব বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। রোগী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। সে সুযোগ এখানে নেই।’
কীটতত্ত্ববিদের মতে, মশা মারতে ফগিং খুবই দুর্বল ও অকার্যকর একটি প্রক্রিয়া। কেননা এটি কেবল উড়ন্ত মশা মারতে ব্যবহার হয়। পরীক্ষার সময় ফগিংয়ের কার্যকারিতা শতকরা ৯০ ভাগের ওপর পাওয়া গেলেও খোলা জায়গায় ফগিংয়ের কার্যকারিতা সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা বলেন, পরীক্ষার সময় ছোট বাক্স বা একটি নির্দিষ্ট স্থানে মশা আবদ্ধ করে ফগিং করা হয়। এতে মশা পালাতে পারে না, তাই তাদের গায়ে সরাসরি ওষুধ লেগে মারা যায়; কিন্তু খোলা জায়গায় ফগিং করতে গেলে প্রথমেই শব্দ শুনে মশা উড়ে যায়। সেইসঙ্গে খোলা বাতাসে ওষুধ দ্রবীভূত হয়ে ওষুধের ঘনত্ব কমে কার্যকারিতা হারায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. আবু ফয়েজ মো. আসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘মশা মারতে ফগিংয়ের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এটি আমাদের দেশে কতটুকু কার্যকর হচ্ছে, তা দেখা দরকার। আবার ঢাকায় যেটার কার্যকর হচ্ছে, অন্য জায়গায় সেটা নাও হতে পারে। তার মানে, পুরো এলাকায় কোন ইনসেকটিসাইডে কতটুকু রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে, সেটা জানার পর যেগুলোতে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না, সেগুলো বাদ দিয়ে বিকল্প খুঁজতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এ দ্বৈততা পরিহার করে আমার মনে হয়, একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এখন যেহেতু ডেঙ্গু পুরো দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে, এখন তো সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে (হোলিস্টিক অ্যাপ্রোচ) কাজ করতে হবে; যাতে আর একটা মানুষও মারা না যায়।’
জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের মায়ামিতে যায়। সেখানে তারা মশা নিয়ন্ত্রণের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। সরেজমিন পরিদর্শন করেন মশক নিধন পদ্ধতি। প্রশিক্ষণ শেষে তারা জানান, এতদিন ভুল পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে ঢাকার দুই সিটি। ফলে কখনোই মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। এখন ভুল পদ্ধতি থেকে বের হয়ে ‘মায়ামি পদ্ধতি’তে মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন তারা।
এরপর তারা এপ্রিলে যান দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে। আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে মশা দমনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দেখে আসেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। এরপর ঘোষণা দেন, ম্যানুয়াল পদ্ধতির চেয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ভেকল মাউন্টেন মেশিন দ্বারা লার্ভিসাইডিংয়ের মাধ্যমে মশা দমন সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি। এভাবে এক দশকে মশা নিধনে শতভাগ সফল হয়েছে সিউলের নগর সরকার। সেই পদ্ধতিই কাজে লাগাতে চাচ্ছে উত্তর সিটি। এভাবে দেশ-বিদেশ ঘুরে মেয়র নানা উদ্যোগের গল্প বললেও বাস্তবে মশক নিধনে এমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি ডিএনসিসি।
একই অবস্থা দক্ষিণেও। ডিএসসিসির মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, মশক নিধনে তিনি আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করবেন। যেসব ওষুধ এতদিন ব্যবহার করা হয়েছে, তা কার্যকর ছিল না। ওষুধের ক্ষেত্রেও আনবেন পরিবর্তন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এখনো সেই আগের ওষুধ ও পুরোনো পদ্ধতিতেই চলছে মশা নিধন।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, মশা নিয়ন্ত্রণে চলতি অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন খরচ করবে ১৬৮ কোটি টাকা। দক্ষিণ সিটির বাজেট ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। উত্তর সিটির বাজেট ১২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, যা দক্ষিণের প্রায় আড়াই গুণ। এবারের বাজেটে মশার ওষুধ কেনার জন্য দক্ষিণের বরাদ্দ ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং উত্তরের ৪৫ কোটি টাকা। ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন পরিবহন খাতে দক্ষিণের বাজেট ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা আর উত্তরের বাজেট ৫ কোটি টাকা। মশা নিধনের যন্ত্রপাতি কিনতে উত্তরের বরাদ্দ ৩০ কোটি টাকা, যেখানে দক্ষিণের বরাদ্দ মাত্র ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর বাইরে উত্তর সিটিতে আগাছা পরিষ্কার ও পরিচর্যা বাবদ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা; মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বিশেষ কর্মসূচি ১ কোটি টাকা, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে মশা নিধন কার্যক্রমে ৩০ কোটি টাকা এবং মশা নিধনে চিরুনি অভিযান পরিচালনায় ২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচারে ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
মশার বংশবিস্তার রোধে এর আগে জলাশয়ে নোভালরুন ট্যাবলেট প্রয়োগ, ড্রেনে গাপ্পি মাছ, জলাশয়ে হাঁস ও ডোবায় ব্যাঙ ছেড়েছিল দুই সিটি করপোরেশন। ড্রোন দিয়ে মশার উৎসস্থলও চিহ্নিত করা হয়। নির্মাণাধীন ভবনে মশার উৎপত্তিস্থল পাওয়া গেলে জরিমানাও করা হয়। বিপুল আয়োজনে চালানো হয় মশক নিধন অভিযান। তবে প্রতি বছরই এসব আয়োজন চলে মশার উপদ্রব বৃদ্ধির পর। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিচ্ছন্নতা কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারেন জনপ্রতিনিধিরা; কিন্তু বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধির মধ্যে এ বিষয়ে আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা গেছে। অন্যদিকে, রাজধানীর নির্মাণাধীন স্থাপনাগুলোকে মশার বংশ বিস্তারের আধার বলা হলেও এক্ষেত্রে মনিটরের অভাব রয়েছে। রাজউক, গণপূর্ত, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার মতো সেবা সংস্থাগুলোর তেমন তৎপরতা চোখে পড়েনি।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না নিলে এ কাজে গতি আসবে না বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘এই চ্যালেঞ্জটা সিটি করপোরেশনগুলো কতটা নিতে পেরেছে—সেটি এখন বড় প্রশ্ন। ডেঙ্গু যে মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে এখন আসলে সিটি করপোরেশনের আর করার কিছুই নেই। যখন একটা ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে কোনো কাজ হয় না।’
তার মতে, ‘সিটি কপোরেশনের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ প্রস্তুতিতে অবশ্যই ঘাটতি ছিল। তারপরও বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে, সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ না করলে পরিস্থিতি এরচেয়ে অনেক ভয়ংকর হতে পারত।’
জানা গেছে, জুলাই মাস থেকে দুই সিটি করপোরেশন বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে অন্তত দেড় কোটি টাকার বেশি জরিমানাও আদায় করেছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি শুধু জরিমানা করেই দায় সারছে। এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। করপোরেশন দাবি করছে, জরিমানা করে সুফল মিলছে। এডিসের লার্ভা পাওয়া ভবনে জরিমানা করার পর ফের অভিযানে এসে দেখা যাচ্ছে লার্ভা আর নেই। অর্থাৎ মানুষ সচেতন হয়েছে। জরিমানা করলে মানুষের টনক নড়ে। যদিও মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা করায় নগরবাসীদের অনেকেই ক্ষুব্ধ।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে জরিমানার ব্যবস্থা বিভিন্ন দেশে থাকলেও বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। জরিমানা করে কোনো লাভ হবে না। যেভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, সে অনুযায়ী কাজ করছে না রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন। নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে না পেরে তারা নাগরিকদের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা করছে।’
কীটতত্ত্ববিদ সাইফুল আলম বলেন, ‘এখানে পরীক্ষিত কোনো মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু নেই। মশা নিধনের ক্ষেত্রে আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। আমরা কি ফগিং করব নাকি লার্ভিসাইডিং করব, নাকি টিকা আনব? কিন্তু আসল কাজ জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর কথা বারবার বলা হলেও কোনো উদ্যোগ নেই।’
এ বিষয়ে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এত টাকা খরচ করার পরও মশা নিয়ন্ত্রণে কেন সুফল আসছে না—তা নিয়ে আমরাও ভাবছি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা ডিএনসিসি থেকে তিন স্তরে কাজ করছি। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এই মুহূর্তে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সবচেয়ে জরুরি।’
মেয়র বলেন, ‘বাড়ির ভেতরে গিয়ে মশার ওষুধ দেওয়া সম্ভব নয়। লার্ভিসাইডিং আমাদের রেগুলার প্রোগ্রাম, আরেকটা হচ্ছে হটস্পট ধরে মশা নিধন। আমরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছি জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর।’
দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনায় আমরা আমূল পরিবর্তন এনেছি। বছরব্যাপী সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের আওতায় পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ, মানসম্পন্ন কীটনাশক ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি জন্য এবং মাঠপর্যায়ে সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। কেউ যদি বলতে পারেন যে, এই পদ্ধতিতে মশা নির্মূল করা যাবে, আমি সেই পদ্ধতি গ্রহণে সবার আগে প্রস্তুত আছি।’
মন্তব্য করুন