মৃত্তিকা সাহা
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৩, ১০:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ খরা

নতুন কেনার চেয়ে ভাঙছে বেশি
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে অনেকেই জমানো সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। অন্যদিকে তাদের পক্ষে নতুন করে সঞ্চয় করার প্রবণতাও কমে গেছে। ফলে তাদের মধ্যে নতুন সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের ফলেও এ খাতে বিনিয়োগ অস্বাভাবিক হারে কমছে। সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগের চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। তবে একক মাস হিসেবে মে মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ বেড়েছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এমন ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা আরও কমিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা বা ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি ছিল।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে সঞ্চয়পত্রে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৭১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। একই সময়ে মূল পরিশোধ বা ভাঙানোর পরিমাণ ৭৭ হাজার ৭৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ ৩ হাজার ২৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা বেশি, যা এর আগে ১০ মাস শেষে ছিল ৩ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। যা সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর একই সময়ে সঞ্চয়পত্রে সরকারকে সুদ বাবদ ৪১ হাজার ৭৮৯ কোটি ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের শুরু থেকেই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলেও অর্থবছরের ১১তম মাসে নিট বিনিয়োগ বেড়েছে। একক মাস হিসেবে মে মাসে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। একই সময়ে মোট জমার পরিমাণ ৬ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মে মাসে নিট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৫১ কোটি টাকা। একই সময়ে সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৩ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।

মে মাসে বিনিয়োগ বাড়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বাজেটের আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে বেশকিছু সুবিধা দেওয়া হবে—গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরে সঞ্চয়কারীরা বেশি বিনিয়োগ করেছেন।

জানা গেছে, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ কমায় স্বস্তিতে রয়েছে সরকার। কেননা এই খাতে সরকারকে অনেক বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়, যা বর্তমানে অনেক কমে গেছে।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক বেশি পরিমাণে বাড়ছিল। এতে সরকারের সুদ পরিশোধের ব্যয়ও অনেক বেশি বেড়ে যায়। সঞ্চয়পত্রের উচ্চ মুনাফা বা সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ছে। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে বিভিন্ন কড়াকড়ি আরোপ করে আসছে সরকার। সরকারের বিভিন্ন শর্তের মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে আয়কর রিটার্ন সনদ বাধ্যতামূলক করা, ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার ২ শতাংশ কমানো, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা, মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা। এ ছাড়া দুর্নীতি কিংবা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেস তৈরি করা হয়েছে। এসব কড়াকড়ির প্রভাবে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে গেছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমানোর পরও তা ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে ব্যাংক আমানতের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদ হারের ব্যবধান আরও কমানোর পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে এই পরামর্শ দিয়েছে তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষযটি বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছে আইএমএফকে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ব্যাংক আমানতের সুদ হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার এখনো অনেক বেশি। এখানে আরও কিছুটা সামঞ্জস্য আনা দরকার। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ায় মেয়াদ শেষে নতুন করে অনেকেই আর বিনিয়োগ করতে পারছেন না।

অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে। তবে বর্তমানে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরাই এ খাতে বিনিয়োগ করছেন। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রকে সামাজিক সুরক্ষার উপকরণ হিসেবে না দেখে আর্থিক উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘কড়াকড়ি আরোপ করার কারণেই মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ খুব বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। এটাও সঞ্চয়পত্র কমার বড় একটা কারণ।

ঋণের বোঝা কমাতে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে টিআইএন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করায় অনেকেই সঞ্চয়পত্রে আগের মতো বিনিয়োগ করতে পারছেন না। তার মতে, আগে কালো টাকাও সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগ হতো। এখন সেটা হচ্ছে না। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে মন্দা দেখা দিয়েছে।

একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন মানুষ আর সঞ্চয়পত্র কিনছে না। এর তিনটি কারণ রয়েছে—প্রথমত, ৫ লাখ টাকার ওপরে সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে আয়কর রিটার্ন দিতে হচ্ছে। কিন্তু নানা রকম ঝামেলার কারণে অনেকেই আয়কর রিটার্ন দিতে চান না। ফলে তারা এখান থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে। দ্বিতীয়ত, যাদের সঞ্চয়পত্র ১ কোটি টাকার বেশি ছিল, সীমা নির্ধারণের কারণে এসব সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে তারা আর নতুন করে কিনতে পারছেন না। তৃতীয়ত, মানুষের হাতে এখন টাকা কম আছে। বর্তমান মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছে না। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার কম ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেক বেশি ঋণ নিচ্ছে, যা আরও বেশি ক্ষতিকর। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা সরাসরি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে।

তিনি আরও বলেন, সঞ্চয়পত্র সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ভূমিকা রাখার কথা না। কারণ এটি একটি আর্থিক উপকরণ। যার মাধ্যমে গ্রাহক মুনাফা লাভ করে। তাই সঞ্চয়পত্রকে আর্থিক উপকরণ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছরমেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদ হার ১১ দশমিক ৫২, পাঁচ বছরমেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদ হার ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছরমেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদ হার ১১ দশমিক ২৮ এবং তিন বছরমেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদ হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখা অফিস, বাণিজ্যিক ব্যাংকের নির্ধারিত শাখা, জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো অফিস ও পোস্ট অফিস থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা যায়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সারাদেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতি শুরু

মোদিকে নিয়ে চাটুকারিতা, বিপাকে বিক্রান্ত ম্যাসি

দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দুপক্ষের ৩ ঘণ্টা সংঘর্ষ, যুবক নিহত

আমরা বাণিজ্যযুদ্ধ চাই না, তবে ভয়ও পাই না : চীন

বিয়ে করতে চান মালাইকা, আছেন প্রস্তাবের অপেক্ষায়

এনসিএল টি-টোয়েন্টির ফাইনালে কে পেলেন কত টাকার পুরস্কার

যশোরে কনকা, গ্রি ও হাইকো ব্র্যান্ডের ডিসপ্লে সেন্টার উদ্বোধন

ঘুম থেকে উঠেই কফি ডেকে আনছে যেসব বিপদ

কুয়াশা আর শিশিরে হেমন্তেই শীতের হাতছানি

আসছে একাধিক শৈত্যপ্রবাহ

১০

ভিটামিন ট্যাবলেট কখন ও কীভাবে খাবেন

১১

সুন্দরবনে ফুট ট্রেইলে ঘুরছে বাঘ

১২

ফ্রান্সে নতুন সরকার গঠন করলেন লেকর্নু

১৩

ক্লাসের ফাঁকে ‘চা খেতে’ গিয়ে ধরা ইবি ছাত্রলীগ নেতা

১৪

টেরিটরি ম্যানেজার পদে নিয়োগ দিচ্ছে নিটল-নিলয় গ্রুপ

১৫

১৩ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৬

ওজন কমাতে সকালের শুরুটা হোক সঠিক খাবার দিয়ে

১৭

১৩ অক্টোবর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৮

অ্যাপ্লায়েন্স বিভাগে নিয়োগ দিচ্ছে ওয়ালটন

১৯

সুলতান’স ডাইনে চাকরির সুযোগ, আজই আবেদন করুন

২০
X